শিক্ষায় চরম বিশৃঙ্খলা
কোচিং বাণিজ্য বন্ধে গতানুগতিক পড়াশোনা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কারিকুলামে শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখন 'বুমেরাং' হয়ে দাঁড়িয়েছে
প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের মালিবাগ শাখার ইংলিশ ভার্সনের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহমিন জাওয়াদ। বছরের শুরুর দিন থেকে খিলগাঁও এলাকার একটি কোচিং সেন্টারে চার সহপাঠীর সঙ্গে ইংলিশের বেসিক গ্রামার শিখছে। একই সঙ্গে তারা বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীর কাছে অংক ও বিজ্ঞান কোচিং করছে। যদিও এই তিন বিষয়ের কোচিংয়েই ক্লাস এইটের পুরানো কারিকুলামের বই পড়ানো হচ্ছে।
তবে নতুন কারিকুলামের যে বই রয়েছে, তার সঙ্গে পুরানো বইয়ের কোনো মিল না থাকায় তাদের স্কুলের শিক্ষকদের কাছে অংক-বিজ্ঞান-ইংলিশ গ্রামারের পাশাপাশি বাংলা ব্যাকরণের জন্য কোচিং করতে হচ্ছে।
তাদের অভিভাবকদের ভাষ্য, নতুন কারিকুলামে প্রতিটি বিষয়ে যে পড়া রয়েছে তা পড়ে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া খুবই কঠিন। তাই সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তারা পুরানো কারিকুলামের বইও পড়াচ্ছেন। তবে এতে নতুন কারিকুলামের চলমান পড়াশোনা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও কোচিং করাচ্ছেন। পুরানো কারিকুলাম অনুযায়ী তারা আগে সন্তানদের নিজেরাই বাসায় পড়ালেও নতুন বইয়ের কোনো কিছুই তারা বুঝতে পারছেন না।
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল, হলিক্রস, ভিকারুন নিসা নূন ও উত্তরা রাজউক স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ প্রায় এক ডজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ সচেতন বাবা-মা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নতুন কারিকুলামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুরানো কারিকুলামের পড়াশোনা সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছেন।
এতে শিক্ষার্থীরাও যেমন চাপে পড়েছে, তেমনি তাদের পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত অভিভাবকদেরও নাভিশ্বাস উঠেছে। আর যাদের আর্থিক সামর্থ্য ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আছে, তারা কেউ কেউ তাদের সন্তানদের বাংলা মিডিয়াম থেকে সরিয়ে নিয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করিয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, কোচিং বাণিজ্য বন্ধে গতানুগতিক পড়াশোনা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কারিকুলামে শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখন 'বুমেরাং' হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন কারিকুলামে লেখাপড়া করানোর জন্য শিক্ষার্থীদের স্কুল শিক্ষকদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আর ভবিষ্যতে যাতে উচ্চ শিক্ষা চালিয়ে যেতে পারে এজন্য গতানুগতিক কোচিং সেন্টারে ছুটতে হচ্ছে।
নতুন শিক্ষাক্রমে
\হবিদ্যালয়ের শিক্ষকের হাতে মূল্যায়নের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। এর ফলে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে, বলা হচ্ছে। কিন্তু অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে কোচিং বাণিজ্যকে আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। যা 'গোদের ওপর বিষফোঁড়া' বলে শিক্ষাবিদরা মন্তব্য করেছেন।
সচেতন অভিভাবকদের দাবি, বর্তমান কারিকুলামের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে কাগজ-কলমে লিখিত কোনো প্রমাণপত্র থাকছে না, তাই শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ের শিক্ষক সর্বনিম্ন পর্যায়ের মূল্যায়ন করলেও কোনও শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের পক্ষে একে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হবে না। শিক্ষা কারিকু্যলামে, পরীক্ষার মোট নম্বরের সিংহভাগ শুধু শিক্ষকের মূল্যায়নের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যৎসামান্য কিছু অংশ বাস্তব পড়া বা লেখার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা বই থেকে দূরে সরে যাবে। তারা বাস্তবতার বিপরীতে শূন্য জ্ঞান এবং শূন্য মেধায় সার্টিফিকেট অর্জন করবে। আর যারা শুধু স্কুল শিক্ষকদের কাছে বর্তমান কারিকুলামে কোচিং করছে, তারা পরীক্ষা ব্যবস্থায় মূল্যায়িত হলেও বাস্তবে পিছিয়েই থাকছে।
এদিকে নতুন কারিকুলামের ফলে গাইড ব্যবসা বন্ধ হবে এবং অভিভাবকরা গাইড ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্তি পাবে এমন কথা বলা হলেও বাস্তবে তার উল্টোটা ঘটছে। অতীতে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার পর দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেরাই পদ্ধতিটি বুঝে উঠতে পারেনি। ফলে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাগুলোতে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাজার থেকে গাইড কিনে এনে সেই গাইড থেকে কপি করে, তা দিয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করতেন। আর এ ক্ষেত্রে তারা প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের বাজার থেকে নির্দিষ্ট কোম্পানির গাইড কিনতে উৎসাহিত করতেন। তাই গাইড ব্যবসা বন্ধ না হয়ে বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। এবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটবে বলে শিক্ষা খাত পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পরিবেশে পড়ানোর পাশাপাশি মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে দক্ষতা, সৃজনশীলতা, জ্ঞান ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে শেখাতেই চালু করা এই নতুন শিক্ষাক্রমে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কতটা শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠবে তা নিয়ে শিক্ষাবিদরা অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
তারা বলছেন, এই কারিকুলামে মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষা যেটুকু আছে তাও শেষ হয়ে যাবে, নবম শ্রেণিতে সবার জন্য গণিত ও বিজ্ঞান অভিন্ন পাঠ্যপুস্তক হওয়ায় টপিক আগের চেয়ে কমেছে। ফলে যারা বিজ্ঞান ও গণিত শিখতে আগ্রহী তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এর মাধ্যমে সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রায় শেষ হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার চেয়ে ব্যবহারিকের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যার ফলে পড়ার চেয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক নানান কাজের চাপ বেড়েছে, যা অনেক অভিভাবকের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ মনে করছেন নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন ছিল, সেটি না নিয়েই কাজ শুরু করেছে সরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মো. মজিবুর রহমান বলেন, মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের জায়গায় অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ অবস্থায় নতুন শিক্ষাক্রমটি কতটা কাজে দিবে, সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ধরনের একটি উদ্যোগ গ্রহণের আগে প্রয়োজনীয় গবেষণার পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত প্রতিটি অংশীদারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করা উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।
অভিভাবক এবং শিক্ষকরা এই উদ্যোগের সবচেয়ে বড় দুই অংশীদার। কিন্তু শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের আগে তাদের সঙ্গে কি বসা হয়েছে? বসা হলে কয়জনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা পরামর্শ করা হয়েছে? তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ধাপে ধাপে এটি বাস্তবায়ন করা হলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।
এদিকে নতুন শিক্ষাক্রমের সুফল ও সফলতা নিয়ে খোদ শিক্ষকরাও সংশয়ে রয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাধ্যমিক স্কুলের একাধিক শিক্ষক জানান, তারা নিজেরাও নতুন কারিকুলাম নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন। নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যদানের জন্য তারা কিছু প্রশিক্ষণ পেলেও যেভাবে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, হুট করে সেটার সঙ্গে তাল মেলানো তাদের পক্ষে কঠিন, ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষেও কঠিন বলে মনে করেন তারা।
নতুন শিক্ষাক্রম গ্রহণ করা হলেও সেটি বাস্তবায়নের জন্য মাঠ প্রস্তুত নেই বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ। তাদের ভাষ্য, দেশে এমনিতেই শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল। তারপরও শিক্ষক যারা আছেন, তারা এই পাঠ্যক্রমে পড়ানোর জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত নন। তাদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ বা সক্ষমতা নেই বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষকদের প্রাইভেট-কোচিং বাণিজ্য থেকে দূরে রাখতে ২০১২ সালে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা জারি করে সরকার। এই নীতিমালা জারির মূলত তিনটি কারণ ছিল। ক্লাসরুমের পাঠদান বাদ দিয়ে শিক্ষকদের প্রাইভেট-টিউশনিতে আগ্রহ, যেসব শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছে টিউশনি-কোচিংয়ে পড়ে না ক্লাসরুমে তার সঙ্গে বিরূপ আচরণ এবং পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়ার অভিযোগ। কিন্তু এই নীতিমালা জারির ১০ বছরেও বাস্তবায়নের হার শূন্য। ফলে যা হবার তাই হয়েছে।
নতুন কারিকুলামের মাধ্যমে এ থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তাভাবনা করা হলেও এক্ষেত্রেও ব্যর্থতার পাহাড় গড়ে উঠেছে। নতুন বছরে স্কুলে লেখাপড়া ঠিকমতো শুরু না হলেও শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য কতটা জমে উঠেছে তা মনিটরিংয়েও শিক্ষা প্রশাসন বরাবরের মতো ভুল পথেই হাঁটছে। এতে অগ্নিমূল্যের বাজারে নাভিশ্বাস ওঠা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের একটি বড় অংশের লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অভিভাবকদের শিক্ষাব্যয় হ্রাস করার জন্য সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করলেও প্রকৃত অর্থে তারা এর সুফল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিগত সময়ে শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই শিক্ষক সমিতিগুলো অতি উচ্চমূল্যের কিছু গাইড বই বেসরকারিভাবে পাঠ্য তালিকাভুক্ত করে অভিভাবকদের পকেট কেটেছে। টেক্সটবুক বোর্ড কর্তৃক বিনামূল্যে সরবরাহকৃত ইংরেজি গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ বই দুটি যথেষ্ট মানসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও নোট-গাইড ব্যবসায়ীদের প্রকাশিত অতি উচ্চমূল্যের গ্রামার ও ব্যাকরণ নামক দুটি বই প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কিনতে হয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের গাইড বইও কিনতে হয়েছে। এ সময় শিক্ষার্থীদের কাছে গৌণ হয়ে যায় বিনামূল্যের পাঠ্যবই। আর মুখ্য ও বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে উচ্চমূল্যের গাইড বই। এই বাস্তবতায় বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহের মহৎ উদ্যোগটি যে লক্ষ্য নিয়ে চালু করা হয়েছিল তা পূরণ হয়নি। অথচ সে টার্গেট পূরণে শিক্ষা প্রশাসন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। মাঝেমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সেগুলোও ব্যর্থ হয়েছে।