ঘুমধুম সীমান্ত এখন শান্ত বাড়ি ফিরেছে মানুষ
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বিজিপির সংখ্যা দাঁড়াল ৩৩০, ১০১ জনকে নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে টেকনাফে স্থানান্তর, ফেরত পাঠানো হবে সমুদ্রপথে
প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে গোলাগুলি কমে যাওয়ায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্ত পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়েছে। ফলে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরেছেন মানুষজন। তবে ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে একটি অবিস্ফোরিত মর্টারলেল উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
এদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সংখ্যা ৩৩০ জনে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে ১০১ জনকে নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে টেকনাফে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাদের সমুদ্রপথে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন।
সম্প্রতি আরাকান আর্মি ও অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের বাহিনীর লড়াই তীব্র হয়ে ওঠে। গত এক সপ্তাহ ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি-মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রম্ন, ঘুমধুম এলাকায় ব্যাপক গোলাগুলি, মর্টারশেলের গোলা, হেলিকপ্টারের সাহায্যে বোমা বর্ষণের ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচ বাংলাদেশি গুরুতর আহত হয়। রকেট ও মর্টারশেলের গোলায় বাংলাদেশি এক নারীসহ দু'জন নিহত হয়। এছাড়াও রকেট লাঞ্চারের গোলায় বসতঘর বিধস্ত হয়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার অবিস্ফোরিত মর্টারশেল উদ্ধার হয়। এমন প্রেক্ষাপটে জনমানব শূন্য হয়ে পড়ে ঘুমধুম এলাকা।
গত মঙ্গলবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রম্ন-ঘুমধুম সীমান্তঘেঁষা ঘুমধুম ইউনিয়নের ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের লোকজনকে সরিয়ে নেয় বান্দরবান জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন সরেজমিনে তুমব্রম্ন-ঘুমধুম সীমান্ত পরিদর্শন শেষে সীমান্তঘেঁষা লোকজনকে সরানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর সেখানকার বাসিন্দাদের উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক হ৫
বিদ্যালয়ে আনা হয়।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থান। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ে নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম চলছে। প্রধান শিক্ষক দীপন বড়ুয়া বলেন, বুধবার বিকালের মধ্যে বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া সব লোকজন চলে গেছেন। বিদ্যালয়ে সীমান্তঘেঁষা এলাকার আতঙ্কিত লোকজন অবস্থান করায় মঙ্গলবার শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
ঘুমধুমের পশ্চিমকূলের বাসিন্দা কুলছুমা বেগম তার দুই শিশুসন্তান নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে ভালো লাগে না। বাচ্চারা ছোট। রাতে তীব্র শীতে তাদের অবস্থা কাহিল হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া গত দুই দিন এলাকায় গোলাবারুদ পড়েনি।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টো বলেন, সীমান্ত এলাকার ২৭ পরিবারের ১৩৭ জন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। সীমান্ত পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসায় সেখান থেকে আশ্রিত ব্যক্তিরা বুধবার চলে যায়।
ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকতে চায় না, বিশেষ করে আশ্রয়কেন্দ্রে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে লোকজন এলাকায় চলে আসে। অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও চলে যায়। অনেকে ক্ষেতখামারের কাজে লেগে যায়। চেয়ারম্যান বলেন, ঘুমধুম সীমান্ত এখন শান্ত। মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক অনেকটা কমে এসেছে।
পালিয়ে আসার সংখ্যা ৩৩০ জনে দাঁড়াল
এদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রীয় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে জাতিগত বিদ্রোহীদের চলমান সংঘর্ষে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা ৩৩০ জনে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্য, সেনা সদস্য, পুলিশ সদস্য, ইমিগ্রেশন সদস্য ও বেসামরিক নাগরিক রয়েছেন।
বিজিবি বলছে, যারা অস্ত্রসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে এখন পর্যন্ত ৩৩০ জন বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
বিজিবি জানিয়েছে, সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত টহল ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে। কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। দেশের স্বার্থে সীমান্তে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে থাকবে বিজিবি।
১০১ জনকে টেকনাফে স্থানান্তর
পালিয়ে এসে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার ১০১ জনকে টেকনাফের হ্নীলায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকালে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রম্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তাদের টেকনাফের হ্নীলায় নেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিবির কয়েকজন কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। পালিয়ে আসাদের মধ্যে ২২৮ জনকে তুমব্রম্ন সরকারি বিদ্যালয়ে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল।
বিজিবি জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের স্বদেশ প্রত্যাবাসন সুবিধাজনক করতে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম থেকে টেকনাফের হ্নীলায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
ঘুমধুম নয়াপাড়া এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ঘুমধুমের তুমব্রম্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় বিজিবির তিনটি বড় গাড়ি আসে। এসব গাড়িতে ১০১ জনকে টেকনাফের হ্নীলায় নেওয়া হয়।
সেনাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে
আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ (বিজিপি) বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের সমুদ্রপ?থে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
বৃহস্প?তিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তা?হিক ব্রিফিংয়ে এ তথ?্য জানান মুখপাত্র সে?হেলী সাবরীন।
তিনি ব?লেন, মিয়ানমা?রের চলমান সংঘাতের কার?ণে বাংলাদে?শে আশ্রয় নেওয়া সেনা সদস?্যদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তা?দের গভীর সমুদ্র দিয়ে দে?শে ফেরত পাঠানো হবে।
কাউকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না বললেও এখন কেন বিজিপি ও অন্যরা ঢুকছে, মিয়ানমার সেনাদের নৌরুটে ফেরত নিতে চাইলেও আমরা কেন বিমানে পাঠাতে চাচ্ছি- এমন প্রশ্নে সে?হেলী সাব?রীন ব?লেন, মিয়ানমার সরকারের নিয়মিত বাহিনী বিজিপি সদস্যদের আশ্রয়দান এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়াকে এক করে দেখা ঠিক হবে না। আশ্রিত বিজিপি সদস্যদের নিরাপদ দ্রম্নত প্রত্যাবাসন প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বিমান বা নৌরুটের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ না কিংবা পূর্বশর্তও না। যত দ্রম্নত সময় তাদের প্রত্যাবাসন করা সম্ভব, সেটা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ এমন প্রস্তাব দিয়েছিল।
মুখপাত্র ব?লেন, কিছুদিন আগে মিয়ানমার ভারত থেকে বিমানযোগে সেনা নিয়ে এসেছিল। সে কারণেই বাংলাদেশ বিমানযোগে সেনাদের ফেরত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ দ্রম্নততম সময়ে তাদের প্রত্যাবাসন চায়। এখানে সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। আশা করা যায়- তাদের দ্রম্নত ফেরত পাঠানো হবে, সেটা আকাশ কিংবা বিমানযোগে। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, তাদের নিরাপদে ফেরত পাঠানো।
তি?নি ব?লেন, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কিংবা রাজনৈতিক কোনো কারণ থাকার প্রশ্ন অবান্তর। সম্প্রতি ভারতেও মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যরা আশ্রয় নিয়েছিল। ভারত থেকে তারা নিজ দেশে ফিরে গেছেন।
সে?হেলী সাবরীন ব?লেন, একটি নিয়মিত বাহিনীর বিপদ্গ্রস্ত সদস্য হিসেবে তারা বাংলাদেশে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছেন এবং প্রথমদিন থেকেই মিয়ানমার সরকার তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে।
পালিয়ে আসা মিয়ানমারের সেনাদের ফিরিয়ে নিতে নেইপিদোর সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্ক জানতে চাইলে মুখপাত্র ব?লেন, মিয়ানমারের সরকার তাদের সেনা ও বিজিপি সদস্যদের ফিরিয়ে নিতে এরই মধ্যে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আশা করা যাচ্ছে, যত দ্রম্নত সম্ভব তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।
প্রতিবেশী হিসেবে বাংলা?দেশ মিয়ানমা?রে স্থিতিশীলতা দেখ?তে চায় জা?নি?য়ে মুখপাত্র ব?লেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মিয়ানমারের শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা দেখতে চায় বাংলাদেশ। মিয়ানমার সংকট উত্তরণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক যে কোনো উদ্যোগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনিবার্যভাবে থাকা প্রয়োজন বলে মনে করে বাংলাদেশ।
ঘুমধুমে অবিস্ফোরিত মর্টারশেল
এদিকে আমাদের নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম নয়াপাড়া এলাকা থেকে অবিস্ফোরিত একটি মর্টারশেল উদ্ধার করেছে বিজিবি। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মর্টারশেলটি উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নুর হোসেন সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ঘুমধুম নয়াপাড়া বিজিবি চেকপোস্টের দক্ষিণ পাশে পথচারীরা মর্টারশেলটি দেখতে পেয়ে বিজিবিকে খবর দেয়। বিজিবি স্থানটি লাল পতাকা দিয়ে ঘিরে রাখে।
স্থানীয় ইউপির ৫নং ওয়ার্ড সদস্য নুর হোসেন বলেন, দুপুর ১২টার দিকে বিজিবির সদস্যরা মর্টারশেলের অবিস্ফোরিত গোলাটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
তবে এ ব্যাপারে বিজিবির আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি আব্দুল মান্নান বলেন, ঘুমধুমে একটি পরিত্যক্ত অবস্থায় মর্টারশেল পাওয়ার খবর শোনেছি। বিস্তারিত জেনে জানানো হবে।