নানা কারণে ঢাকায় আন্দোলন অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখন দেশের অন্যান্য স্থানে আন্দোলন জোর কদমে এগিয়ে চলে। কোথাও কোথাও আন্দোলন বিস্ফোরক চরিত্র লাভ করে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, চট্টগ্রাম, যশোর, কুমিলস্না, ময়মনসিংহ, বরিশাল, ফরিদপুর ও নোয়াখালীসহ প্রতিটি জেলা ও মহকুমায় ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্যাপকতা ছিল লক্ষ্য করার মতো।
এসব জেলায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ঢাকার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যোগাযোগ ছিল ক্ষীণ। এ ছাড়া এখনকার মতো সহজ যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। তারা একুশের কর্মসূচি নিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে আন্দোলনে নামেন ও সাফল্য পান। ঢাকার মতো বাইরের শহরগুলোতে দমননীতি ও পুলিশি জুলুম ছিল অনেক বেশি।
নারায়ণগঞ্জের ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা একপর্যায়ে অল্পসময়ের জন্য গণআন্দোলনের চরিত্র অর্জন করে। আন্দোলনের প্রধান চরিত্রে ছিলেন- স্থানীয় মর্গান স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম। তিনি অনমনীয় ভূমিকা রেখেছিলেন আন্দোলনে। অনন্য দক্ষতার সঙ্গে শহরের ছাত্রী ও নারীদের আন্দোলনে যুক্ত করেন। ফেব্রম্নয়ারির উত্তাল সময়ের পুরোটাতেই তাকে প্রতিটি সভা-সমাবেশ ও মিছিলের সামনে দেখা গেছে। এক সময় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারও করে। তাকে ঢাকায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিলে চাষাড়ায় পুলিশ-জনতার সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বেশ কৌশল করে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের নেতৃত্বে আরও ছিলেন- শামসুজ্জোহা, সফি হোসেন, আলমাস আলী, খানবাহাদুর ওসমান আলী প্রমুখ।
ময়মনসিংহেও ভাষা আন্দোলন অনেক তীব্রতা নিয়ে সংগঠিত হয়। রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, হাতেম আলী তালুকদার প্রমুখ নেতার প্রচেষ্টায় আন্দোলন শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। শহরে মোনায়েম খাঁর উর্দুর পক্ষে প্রচারের চেষ্টা জনতার প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়।
কুমিলস্না শহরে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসমাবেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পাশাপাশি মন্ত্রিসভার পদত্যাগের দাবি ওঠে। এর প্রভাব গ্রামের স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পাশের মহকুমা শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর ব্যতিক্রম ছিল না।
একুশের গুলিবর্ষণের খবর পৌঁছানোর পরপরই চট্টগ্রামে আন্দোলন বিশেষ মাত্রা লাভ করে। চট্টগ্রামের আন্দোলনের উলেস্নখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো- স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের অংশগ্রহণ। এ ছাড়া মাদ্রাসা ছাত্র আহম্মেদুর রহমান আজমীরের আন্দোলনে অংশগ্রহণও ছিল উলেস্নখযোগ্য ঘটনা।
রাজশাহীতে ডান-বাম-মধ্যপন্থি বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। কমিটির উদ্যোগে একুশে ফেব্রম্নয়ারি দিনব্যাপী হরতাল, ভুবনমোহন পার্কে সভা ও মিছিলের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলনে ছাত্রীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। জেলা শহরের বাইরেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
বগুড়ার আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল সর্বস্তরের সংগঠনের অংশগ্রহণ। এতে অংশগ্রহণ করে যুবলীগ, শ্রমিক ইউনিয়ন, আওয়ামী লীগ ও তমদ্দুন মজলিসসহ কৃষক সংগঠন ও বামপন্থি ছাত্র-যুবা-রাজনীতিক, স্থানীয় শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী ও বিভিন্ন পেশার মানুষ।
আন্দোলনের ঐতিহ্য নিয়ে যেমন পাবনা, তেমনি খুলনা, যশোরও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ধারায় ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়। তবে এসব ক্ষেত্রে দমননীতির তীব্রতায় অথবা অন্য কোনো কারণে আটচলিস্নশের আন্দোলন বায়ান্নের তুলনায় ছিল জঙ্গি চরিত্রের। সিলেটে সাতচলিস্নশের নভেম্বর থেকে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং বায়ান্নের ফেব্রম্নয়ারির প্রথম দিকে পীর হাবীবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। একুশে ফেব্রম্নয়ারি সন্ধ্যার পর ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। পরদিন হরতালসহ লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকে। এখানে ছাত্রী ও নারীরা অংশগ্রহণ করেন।
রংপুর ও দিনাজপুর উভয় জেলাতেই আন্দোলন সর্বদলীয় ভিত্তিতে জোরদার হয়ে ওঠে। আন্দোলনের তীব্রতার সঙ্গে সমানতালে ছিল প্রশাসনের দমনপীড়ন। কিন্তু জনচেতনার কাছে প্রশাসন পিছু হঠতে বাধ্য হয়। বরিশালে বায়ান্ন সালের তৎপরতা ছিল বিএম কলেজকে ঘিরে। এখানে ছাত্রীদের বিশেষ ভূমিকা ছিল এবং ২৪ ফেব্রম্নয়ারি একটি শহীদ মিনারও তৈরি হয়।