গরমে হতে পারে তীব্র লোডশেডিং

প্রকাশ | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
আসছে গরমে তীব্র লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সর্বোচ্চ চাহিদার সময় গরমে ৫শ' থেকে এক হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হতে পারে। তবে যদি জ্বালানি আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটে এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি মূল্যে নতুন কোনো সংকট তৈরি হয় সেক্ষেত্রে দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। আর বিদু্যৎ উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি যেহেতু জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তাই ডলার সংকটের এ সময় এ জটিলতা নিরসন করা কঠিন হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থনীতিবিদরা বলেন, সরকারের ভুল নীতির কারণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি। এ ছাড়া সক্ষমতা থাকার পরও চাহিদা অনুযায়ী বিদু্যৎ উৎপাদন করতে না পারাটা মূলত সরকারের কাঠামোগত সমস্যা। দেশের আর্থিক পরিস্থিতি এবং ডলার সংকট মিলিয়ে এ বছর গরমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিদু্যতের চাহিদা কীভাবে সামাল দেয় সেটি দেখার বিষয়। তবে সংকটের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ চলছে বলে জানিয়েছে বিদু্যৎ বিভাগ। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ বছর গ্রীষ্মে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে। আর এজন্য প্রয়োজন হবে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার টন কয়লা। তবে গত বছর কয়লার মূল্য পরিশোধ করতে বিলম্বের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিদু্যৎ কেন্দ্র পায়রা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। টানা ২৫ দিন এটি বন্ধ থাকায় দেশজুড়ে ব্যাপক বিদু্যৎ সংকট তৈরি হয়। তাই এবার আগেভাগেই বিপুল পরিমাণ কয়লা আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। চীন থেকে কয়লা আনার এলসি খুলতে কোনো জটিলতা না থাকায় এবং এ বছর কয়লার দাম গত বছরের তুলনায় কমে আসায় সমস্যা কিছুটা কম হবে বলে আশাবাদী তারা। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, নতুন কিছু কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎ উৎপাদনে আসবে। যেগুলোর মাধ্যমে আমরা আশা করছি যে, যখন মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত এ সময়টা আমাদের চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। কারণ তখন সেচ থাকবে, রমজান থাকবে। সেটাও আমরা সামাল দিতে পারব। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলার ও জ্বালানি সংকট না কাটলে গরমে নিরবিচ্ছিন্ন বিদু্যৎ সরবরাহ সম্ভব হবে না। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ে আদানির বিদু্যৎ না আসায় আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, বিদু্যৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে জ্বালানি এবং তার সঙ্গে সমান হারে কয়লা, গ্যাসভিত্তিক বিদু্যৎ বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়া বিদু্যৎ সংকটের নেপথ্যে জ্বালানি খাতে সরকারের ভুল নীতিকে দুষছেন তিনি। জ্বালানি সংকট সমাধান না হলে রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। এদিকে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো আশানুরূপ বিদু্যৎ উৎপাদন করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্টরা। পিডিবির তথ্য বলছে, দেশে বেসরকারি খাতে বিদু্যৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ৭৮টি। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৮ হাজার ৭৭৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে তেলভিত্তিক ৪৭টি কেন্দ্রের ক্ষমতা ৫ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াট। অথচ বেসরকারি বিদু্যৎ কোম্পানিগুলো বিদু্যৎ কেন্দ্রের জন্য চাহিদা অনুযায়ী তেল আমদানি করতে পারছে না। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বিপিসির কাছ থেকে তেল কিনতেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। গরমে উৎপাদন নিশ্চিত করতে জরুরিভিত্তিতে ডলারের সাপোর্ট দরকার। তবে এ সহায়তা মিলবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন ডলার সংকট এবং এলসি জটিলতা না কাটলে বিদু্যৎ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে এ বছর। দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, আগামী তিন মাসের জন্য বেসরকারি বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোর তেল আমদানির জন্য আড়াইশ থেকে তিনশ মিলিয়ন ডলারের একটা সাপোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চাওয়া হয়েছে। এদিকে জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানি নির্ভরতার কারণে বিদু্যৎ উৎপাদনে জ্বালানি খরচ বাড়ছে এবং সেটা সরাসরি ডলারের ওপর চাপ তৈরি করছে। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী ভারত থেকে আমদানি, আদানির বিদু্যৎসহ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের জ্বালানি খরচ হয়েছে ৬১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে একটা বড় অংশই তেল ও কয়লা বিদু্যতের জ্বালানি খরচ। বিদু্যৎ খাতের পরিকল্পনা দেখে বিশ্লেষকরা আরও বলেন, আমদানিনির্ভরতার সংকট কেমন হতে পারে তার একটা দৃষ্টান্ত হলো ২০২২-২৩ সাল। ওই বছর বিদু্যৎ উৎপাদনের জ্বালানি আমদানির জন্য অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। পিডিবি সূত্র জানায়, ফেব্রম্নয়ারির মাঝামাঝি থেকেই বাড়তে শুরু করবে বিদু্যতের চাহিদা। আর এবার গরমে সেটি ১৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ পরিমাণ বিদু্যৎ উৎপাদন করতে দরকার হবে বিপুল পরিমাণ তেল, গ্যাস এবং কয়লা। চলমান ডলার সংকট, গ্যাস সংকট এবং আর্থিক চাপের মধ্যে এবার প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদু্যৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে কিনা সেটি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই তারা জোনভিত্তিক লোডশেডিংয়ের শিডিউলও আগাম তৈরি করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিদু্যৎ উৎপাদনের একদিনে সর্বোচ্চ রেকর্ড ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। গত বছর ১৯ এপ্রিল উৎপাদন হয়েছিল এ পরিমাণ বিদু্যৎ। তবে এ বছর গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হতে পারে। এ হিসাবে দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করা প্রয়োজন হবে। জ্বালানি খাত পর্যবেক্ষকরা জানান, বাংলাদেশে বিদু্যৎ সংকট মেটাতে রূপপুর পারমাণবিক, রামপাল এবং পায়রার মতো বড় বড় বেশকিছু জ্বালানি প্রকল্প শুরু করেছিল সরকার। তখন আশা করা হয়েছিল, এসব প্রকল্প চালু হয়ে গেলে দেশে বিদু্যতের ঘাটতি আর থাকবে না। কিন্তু এখন অব্যাহত বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে এসব প্রকল্প সরকারের জন্য নতুন জটিলতা তৈরি করেছে। যা গরমের মাত্রা আর একটু বাড়লেই আরও স্পষ্ট হতে শুরু করবে। কারণ গত বছরও ডলার সংকটের কারণে একদিকে এসব কেন্দ্রের কাঁচামাল আমদানি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এবারও ঠিক সময় কাঁচামাল আনতে না পারার কারণে কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখতে হতে পারে। এ ছাড়া তেলের চড়া মূল্যের কারণে ভাড়ায় চালিত কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করা নিয়েও জটিলতা রয়েছে। ফলে গরমকাল আসতে শুরু করায় বিদু্যৎ সরবরাহ কতটা স্বাভাবিক রাখা যাবে, তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, এক সময় দেশীয় গ্যাস ব্যবহার করে বিদু্যৎ উৎপাদন করা হতো। তখন দেশীয় গ্যাস কিনতে হয়েছে তিন ডলারে কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে অনেক কমে গেছে। এর পরিবর্তে এখন বিশ্ববাজার থেকে এলএনজি আনতে হচ্ছে অন্তত ৪ গুণ বেশি দরে। স্পট মার্কেট থেকে কিনলে সেটি ২০ ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখানেও বড় অংকের ডলার চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে সংকট সামাল দিতে রামপাল, পায়রা ছাড়াও আরও কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বড় বিদু্যৎ কেন্দ্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কক্সবাজারের মাতারবাড়ী আর চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে আরও দুটি বড় আকারের বিদু্যৎ কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। বরিশালের ও ঢাকায় মাঝারি আকারের দুটি কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎ কেন্দ্রের কাজ চলছে। এসব বিদু্যৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করা কয়লার ওপর ভিত্তি করে। এগুলোর জন্য কয়লার বিশাল সাপস্নাই লাগবে। পুরোটাই আমদানি করতে হবে। এগুলোর জন্যও অনেক ডলার প্রয়োজন। ডলার ক্রাইসিস এরকম থাকলে সেটা কতটা পারা যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আবার কয়লা আমদানি করতে না পারলেও বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখতে হলেও সরকারকে বিপুল অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। এদিকে এর আগে ডিজেলচালিত বিদু্যৎকেন্দ্র বন্ধ করে সরকার ডিজেলের ওপর চাপ কমানোর চেষ্টা করলেও তা খুব বেশি কমেনি। কারণ লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যক্তিগত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জেনারেটরে ডিজেল ব্যবহার করতে শুরু করেন। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এ বছরেও সরকারকে সেই নীতিরই অনুসরণ করতে হতে পারে। সেটা হলে বড় ধরনের লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।