মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসছে সীমান্তরক্ষীরা
গোলাগুলি কমলেও আছে আতঙ্ক 'সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুত বিজিবি '
প্রকাশ | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আবদুল হামিদ, নাইক্ষ্যংছড়ি ও আরাফাত সানি, টেকনাফ
মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াইয়ের মধ্যে গোলাগুলি কিছুটা কমেছে। তবে বাংলাদেশের ঘুমধুম ইউনিয়নে স্থানীয়দের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। জনশূন্য রয়েছে বহু বসতবাড়ি। বিশেষ করে দিনের বেলায় কেউ বাড়িতে থাকছেন না। তবে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। বুধবার দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৬৪ জন সদস্য নতুন করে প্রবেশ করেছে। এ নিয়ে গত চার দিনে মোট ৩২৮ জন পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে, বিজিবির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জান সিদ্দিকী জানিয়েছেন, পরিস্থিতি যাই হোক না কেনো, সীমান্ত দিয়ে একজনকেও বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যেকোনো পরিস্থিতিতে সবোর্চ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত বিজিবি।
সম্প্রতি আরাকান আর্মি ও অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের বাহিনীর লড়াই তীব্র হয়ে ওঠে। গত এক সপ্তাহ ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি-মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রম্ন, ঘুমধুম এলাকায় ব্যাপক গোলাগুলি, মর্টার শেলের গোলা, হেলিকপ্টারের সাহায্যে বোমাবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এতে ৫ বাংলাদেশি গুরুতর আহত হন। রকেট ও মর্টার
শেলের গোলায় বাংলাদেশি এক নারীসহ দুইজন নিহত হন। এ ছাড়াও রকেট লঞ্চারের গোলায় বসতঘর বিধ্বস্ত হয়। এমন প্রেক্ষাপটে অন্তত ৮টি গ্রাম জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য দীল মোহাম্মদ ভুট্টো জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাতের মাঝামাঝি সময় থেকে তুমব্রম্ন সীমান্তে কোনো প্রকার গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়নি।
ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, মোটামুটি পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখা গেলেও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। এই পরিস্থিতির কারণে উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
সর্বশেষ বুধবার বিকাল পর্যন্ত সীমান্তে কোনো গোলাগুলির খবর পাওয়া যায়নি।
সরেজমিন ঘুমধুম ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, অনেক গ্রামবাসী বাড়িঘর ছেড়েছে। ফাঁকা রয়েছে স্থানীয় হাটবাজার। তবে কোনো কোনো বাড়িতে গবাদিপশু ও পুরুষ সদস্যদের দেখা গেছে।
তারা বলছেন, দিনের বেলায় কেউ বাড়িতে থাকছেন না।
এর আগে মঙ্গলবার সীমান্ত পরিদর্শনে গিয়ে বান্দরবান জেলা প্রশাসক মুজাহিদ উদ্দিন ও জেলা পুলিশ সুপার মো. সৈকত শাহীন ঝুঁকিত বসবাসকারী জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন।
পালিয়ে এসেছেন ৩২৮ জন
এদিকে, নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির আরও ৬৪ জন।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, বুধবার কক্সবাজারের টেকনাফের উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের ওই সীমান্তরক্ষীরা বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। পরে তাদের হেফাজতে নেয় বিজিবি।
এ নিয়ে গত চার দিনে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ মোট ৩২৮ জন পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন।
হোয়াইক্যং মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, 'মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত কিছুটা কমেছে। গত রাত থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় গোলাগুলির শব্দ কমেছে। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটা শব্দ শোনা গেলেও বিস্ফোরণের শব্দ প্রায় নেই।'
এই ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম লালু বলেন, 'বুধবার বেলা ১১টার দিকে কিছুক্ষণ গোলাগুলির পর মিয়ানমার থেকে কিছু বিজিপি সদস্য ছত্রভঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করে। পরে বিজিবি সদস্যরা তাদের নিরস্ত্র করে বাংলাদেশে ঢোকায়।'
সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রস্তুত বিজিবি
এদিকে, বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রম্ন ও ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন বিজিবির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জান সিদ্দিকী। পরিদর্শন শেষে ঘুমধুমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজে বিজিবি মহাপরিচালক সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি যাই হোক না কেনো, সীমান্ত দিয়ে একজনকেও বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যেকোনো পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত বিজিবি।
বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিজিবির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে ধৈর্যধারণ করে, মানবিক থেকে আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হচ্ছে। দেশ মাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সীমান্ত উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত রয়েছে।
সীমান্ত পরিদর্শনকালে বিজিবির সব স্তরের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন বিজিবির নয়া পরিচালক। এ সময় তিনি বিজিবি সদস্যদের দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দেন।
বিজিবি মহাপরিচালক বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়নামারের বিজিপি, সেনা, ইমিগ্রেশন পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের খোঁজখবর নেন এবং মিয়ানমারে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন বিজিপি সদস্যদের দেখতে যান। পরিদর্শনকালে বিজিবি সদর দপ্তর, কক্সবাজার রিজিয়ন, সেক্টর ও ব্যাটালিয়নের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।