উত্তাল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশ | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
১৯৫২ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে দিন যত এগোতে থাকে ততই বাঙালিরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মায়ের ভাষা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে সব বাঙালি এক কাতারে শামিল হয়। দেশের সব রাস্তা তখন ঢাকায় এসে এক বিন্দুতে মিশেছে। জেলা শহর, মহকুমা শহর থেকে লোক আসছে, লোক যাচ্ছে। এক কথায় সাংগঠনিক তৎপরতা চলছে দেশজুড়ে। রাজনৈতিক আবহাওয়ার উত্তাপে উধাও হয়ে যাচ্ছে শীতের আমেজ। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহর তখন উত্তাল। নারায়ণগঞ্জ একুশ নিয়ে তখনো একপা এগিয়ে। সেখানে শামসুজ্জোহা, সফি হোসেন, মমতাজ বেগম ও অনুরূপ কয়েকজনের নেতৃত্বে আন্দোলন চলছে। ঢাকার মতোই স্কুলের কমবয়সি ছাত্রছাত্রীরাও পিছিয়ে নেই। তারা স্কুল ছেড়ে পথে, মাঠ-ময়দানের জনসভায় হাজির। ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক যোগাযোগ বরাবরই গভীর। সেখানকার পোস্টার-দেয়াললিপি একুশের জন্য ডাক পাঠাচ্ছে ছাত্রছাত্রী, তরুণ ও সর্বজনতার দিকে। শ্রমিক অঞ্চল নারায়ণগঞ্জের প্রত্যাশা শ্রমজীবী মানুষও এ আন্দোলনের পক্ষে সাড়া দেবেন, ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়াবেন। ভাষার প্রশ্নটা তাদের জন্যও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ গোটা বাঙালি জাতির জন্য। পতাকা দিবসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢাকায় পোস্টার লেখার ধুম পড়ে গিয়েছিল। শুধু চারুকলার ছাত্র, ইমদাদ বা আমিনুলই নয়, তাদের সঙ্গী বেশ ক'জন এ কাজে যেমন ব্যস্ততা দেখিয়েছেন তেমনি মেডিকেল কলেজের ছাত্র বদরুল, জিয়া হাসান, নুরুল ইসলামসহ কারও কারও আঙুলে চেপে বসে রয়েছে লালকালির ছোপ, লাল বর্ণমালার বিজয় নিশ্চিত করতে। এ কাজে তৎপর হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীও। ঢাকার সিদ্ধান্ত, বেলতলার আহ্বান আর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সমর্থনে প্রদেশজুড়ে একুশের প্রস্তুতি, যত দিন যাচ্ছে ততই চলছে জোর কদমে। সুদূর উত্তরাঞ্চলের রংপুর, নীলফামারী, ডোমার, রাজশাহী, দিনাজপুর থেকে সর্বদক্ষিণে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর আর উত্তর-পূর্বে সিলেট, ময়মনসিংহ এবং মধ্যখানে কুমিলস্না, ব্রাহ্মণবাড়িয়া- আন্দোলিত এক বিশাল ক্যানভাস। বাদ যায়নি উত্তপ্ত পাবনা, বগুড়া, যশোর বা খুলনা। এ ছাড়াও মহকুমা শহর থেকে থানা- সব শিক্ষায়তনে এ আহ্বানে সাড়া পড়ে। দেশের সব কয়টা সাপ্তাহিক তাদের প্রতিবেদনে দেশব্যাপী বিক্ষোভ চেতনার চিত্র তুলে ধরে। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক (১০ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৫২) আবেগ ঝরানো ভাষায় লেখে ছাত্রদের ডাকা হরতাল উপলক্ষে : 'ছাত্র হরতাল মহড়াই প্রদেশের সর্বত্র শোভাযাত্রা ও সংগঠনে রূপান্তরিত হইয়াছে। ইহাতে স্পষ্ট উপলব্ধি জাগে- বাংলাভাষা ও বর্ণের অধিকার আজ এই প্রদেশবাসীর হৃদয়ে কতখানি অধিকার করিয়া আছে। এই সুপ্ত আবেগের মহড়ার স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তিই ভবিষ্যৎ আন্দোলনের ইঙ্গিত জানায়- ২১ ফেব্রম্নয়ারির আগমনী ঘোষণা করে। ...প্রদেশের সর্বত্রই এই চেতনার নবজাগরণ দেখা দিয়াছে।' এভাবে একুশের আগেই একুশের চেতনার আত্মপ্রকাশ হয় বাংলা ভাষাভাষীদের হৃদয়ের উপলব্ধি থেকে। এই উপলব্ধি যেমন মাতৃভাষা নিয়ে মমতার, তেমনি মাতৃভূমিকে ঘিরে ভালোবাসার। কোথায় পাহাড়ি সাতকানিয়া আর কোথায় মাদারীপুর বা মেঘনা পারের চাঁদপুর- সর্বত্র অস্থিরতা। এর মধ্যে দিনাজপুরে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ভাষার দাবির পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সেস্নাগান তুলে আন্তর্জাতিক চেতনারও প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানেও ভাষা চেতনার লাল ছায়া দুলছে। পদ্মা-মেঘনার সঙ্গমস্থলের শহর চাঁদপুরে স্কুল-কলেজের ছাত্র, মজদুর ও জনসাধারণ রাষ্ট্রভাষা দিবস (সাপ্তাহিক ইত্তেফাক) নিয়ে উন্মাতাল। পত্রিকার প্রতিবেদন মতে, যুবলীগের ভূমিকা হয়ে ওঠে বিশেষ এবং তা বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলে। এ সময়ের দুটি ঘটনা একুশের প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। প্রথমত, মওলানা ভাসানীর সাংগঠনিক সফর এবং তা জেলা থেকে মহকুমায়, এমনকি তার রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে থানা বা দূর প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সরকারবিরোধী এ প্রচার জনমানসে প্রভাব ফেলেছে। স্বভাবতই একুশের আহ্বানে মানুষের পক্ষে সাড়া দেওয়া সহজ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, বন্দি মুক্তি নিয়ে, সরকারি অন্যায় ও জুলুম নিয়ে প্রতিবাদও জনচিত্তে দাগ কাটে। মুসলিম লীগের দুঃশাসন সম্বন্ধে মানুষ ক্রমশ সচেতন হতে থাকে। ভাসানীর ওই সাংগঠনিক সফর পুরো একুশের কর্মসূচি পালনের ভিত তৈরি করে। ছাত্রদের ভাষাবিষয়ক আন্দোলনের দিকে জনসাধারণেরও নজর পড়ে। ছাত্র-যুব নেতাদের সাংগঠনিক ঘাটতি এভাবে পূরণ হতে থাকে। মুসলিম লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের উৎস হয়ে ওঠে একুশে ফেব্রম্নয়ারির কর্মসূচি।