মিয়ানমার সংঘাত :ফের সংকটে পড়তে পারে দেশ!
প্রকাশ | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বীরেন মুখার্জী
মিয়ানমারের বৃহত্তর রাখাইন রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সামরিক জান্তার সঙ্গে দেশটির জাতিগত বিদ্রোহী 'থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স'র তুমুল লড়াই অব্যাহত আছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী তিন মাসের বেশি সময় ধরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ চালিয়ে বিদ্রোহীরা দেশটির শান, রাখাইন, চীন ও কেয়াহ রাজ্যের ৩০টিরও বেশি শহর দখলে নিয়েছে। বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে জান্তা সরকারের সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি সেনা নিহত বা আটক হয়েছেন। এদের মধ্যে ১০ জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রয়েছেন। মিয়ানমার সেনা ও বিদ্রোহীদের বিরতিহীন সংঘাতে সীমান্ত গলিয়ে ভারত-চীনের মতো বাংলাদেশেও অনুপ্রবেশ ঘটছে সশস্ত্র সেনাদের। সংঘাত ঘিরে প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি। সে দেশের চলমান সংঘাতে ব্যবহৃত গোলা এসে পড়ছে এদেশের লোকালয়ে। ইতোমধ্যে দুজন নিহতও হয়েছেন। এ ছাড়া
সীমান্তের ওপারের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সীমান্তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আতঙ্কে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো জনশূন্য হতে শুরু করেছে।
তথ্য অনুযায়ী সংঘাতের জেরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার শূন্যরেখায় মানুষের ভিড় বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাদের আশঙ্কা, মিয়ানমারে সংঘাতের প্রভাবে ফের সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশ। অতীতের মতো ঘটতে পারে বড় ধরনের অনুপ্রবেশের ঘটনা। এ ছাড়া তৃতীয় পক্ষের কোনো ধরনের উসকানিতে অধৈর্য না হওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত থেকে নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
তবে সরকার বলছে, স্থল ও জলসীমায় কঠোর-সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। সাম্প্রতিক ঘটনার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মিয়ানমার দূতকে তলব করে সতর্ক করেছে। আর বিজিবির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক বলেছেন, কোনো অবস্থায়ই অনুপ্রবেশ ঘটতে দেওয়া হবে না। অন্যদিকে সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবিকে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। সামরিক অভু্যত্থানে উৎখাত করা হয় অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে। তখন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু করে সাধারণ জনগণ। কিন্তু মিয়ানমার পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভ দমনে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালে গণতন্ত্রপন্থিদের একাংশ জান্তাবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোতে যোগ দেওয়া শুরু করে। মূলত এ সময় থেকেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেনাদের সংঘাত বেড়ে যায়।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর 'অপারেশন-১০২৭' নামে জাতিগত বিদ্রোহী 'থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স' জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এরা হলো- তা'আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ)। এ জোটের অন্যতম আরাকান আর্মি মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর একটি সশস্ত্র বাহিনী।
মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম 'ইরাবতী' এক প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেছে, বিদ্রোহীরা দেশটির সাগায়িং, ম্যাগওয়ে ও মান্দালা অঞ্চলসহ কাচিন এবং কারেন প্রদেশে সেনাঘাঁটি দখলের পাশাপাশি সেনাদের হত্যা করছে।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) তথ্য অনুযায়ী নতুন করে সংঘাত শুরু হওয়ায় গত পাঁচ দিনে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রম্ন সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ২২৪ সদস্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে দেশে। এদের নিরস্ত্র করে আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'সীমান্ত আমাদের রক্ষিত আছে। তারা (বিজিপি সদস্য) যেহেতু পালিয়ে এসেছে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি।'
এদিকে, রাখাইনে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতে যে 'মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি' তৈরি হয়েছে তাতে আটকেপড়া বাসিন্দাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালানোর আশঙ্কা দেখছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়। চলমান সংঘাতের মধ্যে রাখাইনের বেশকিছু চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের মানুষের মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের শূন্যরেখায় জড়ো হওয়ার তথ্য দিয়েছেন এপারে থাকা তাদের স্বজনরা। শূন্যরেখায় মানুষের জড়ো হওয়ার কিছু ভিডিও চিত্র সেখান থেকে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে বলেও তারা দাবি করেছেন।
এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, 'বিগত কয়েকদিন ধরেই সীমানার ওপারে রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে শুনতে পারছি যে, সেখানে একটি মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় আমরা বিভিন্ন পয়েন্টে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছি। আমরা এমনিতেই ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গা নিয়ে গত ছয়-সাত বছর ধরে হিমশিম খাচ্ছি। এখন রাখাইন থেকে যদি আরও অনুপ্রবেশ ঘটে তাহলে সেটি আমাদের জন্য ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করবে।'
বিজিবির কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোর্শেদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, 'আমাদের সীমান্ত সিল করা আছে। আমরা কোনোভাবেই রোহিঙ্গা বা অন্যদের এখানে অনুপ্রবেশ করতে দেব না। বিজিবি সেখানে কাজ করছে।'
তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সে দেশে সংঘাত চলছে। ১৯৬২ সালে দেশটির ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। এরপর দীর্ঘসময় ধরে জান্তা বাহিনীর হাতে ক্ষমতা থাকলেও ২০১৫ সালের এক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি), যার নেতৃত্বে ছিলেন নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি। ২০২০ সালের নির্বাচনে দলটির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা সামরিক শাসকদের কাছে হুমকি মনে হওয়ায় পরের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের পয়লা ফেব্রম্নয়ারি অভু্যত্থানের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেয় সামরিক বাহিনী। তবে এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি দেশটির সাধারণ জনগণ। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এলে কঠোর হাতে তাদের দমন শুরু করে সামরিক বাহিনী।
এদিকে ২০২৩ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর অভু্যত্থানের পর সেনাবাহিনী দেশজুড়ে ক্র্যাকডাউন চালায়। এতে ১৬ হাজারেরও বেশি গণতন্ত্রকামী মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ হেফাজতে মারা যান ২৭৩ জন। এ ছাড়া নির্বিচারে গণহত্যা, গ্রেপ্তার, অত্যাচার, যৌন সহিংসতাসহ অন্য নিপীড়নের কথাও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত চলমান থাকলেও এবারের সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির জান্তা শাসকরা। বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে বিভিন্ন প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রতিবেশী দেশে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার খবর প্রতিদিনই উঠে আসছে সংবাদমাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিসের মূল্যায়নে নিয়ে বিবিসি সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায়, মিয়ানমারে বর্তমানে কর্তৃত্ববাদ বিরোধী যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে তা এখনো পর্যন্ত সফল বলেই মনে হচ্ছে। টানা দুই বছর ধরে ছোট ছোট সফলতা পাওয়ার পর এই আন্দোলন ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে সুসংগঠিতভাবে দেশজুড়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে, যা এখন আসলেই জান্তা সরকারের শাসনকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় কি হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান যায়যায়দিনকে বলেন, 'রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে যে প্রচেষ্টা চলছে, মিয়ানমারের বর্তমানে পরিস্থিতিতে সেটি মারাত্মকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হলো। এ বিষয়টি যে এখন শুধু মিয়ানমার সরকারের হাতে নেই- সেটি স্পষ্ট। দেশটিতে যেসব শক্তির উত্থানের খবর পাচ্ছি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এদের ভূমিকাও এখন তৈরি হবে।'
তিনি বলেন, 'সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সেদেশে সংঘাতের ঘটনায় স্পষ্ট যে, সবকিছু শাসকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে জান্তা সরকার কিংবা তৃতীয় কোনো পক্ষ নানাভাবে উসকানি দিয়ে আমাদের দেশেও যুদ্ধাবস্থা তৈরি করতে পারে, আমাদের জড়িয়ে ফেলতে পারে। এ বিষয়ে অধিক সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। কারও উসকানিতে অধৈর্য হওয়া যাবে না।'
'অনুপ্রবেশকারী সেনাদের অবশ্যই ফেরত পাঠাতে হবে। তবে সেক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হতে পারে। ওদের ফেরত পাঠালে জান্তা সরকার তাদের হত্যা করতে পারে। যদিও বিষয়টি একান্তই তাদের তারপরও আমাদের খুব সতর্কতা নিয়ে এগোতে হবে। অনুপ্রবেশকারীরা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। ফলে তাদের ফেরত পাঠাতে হবে' বলেন তিনি।
সীমান্তের শূন্যরেখায় অনুপ্রবেশের আশায় ভিড় বাড়ছে- এ বিষয়ে অধ্যাপক শাহাব এনাম বলেন, 'বিষয়টি মানবিক হলেও অনুপ্রবেশের বিষয়ে কঠোর থাকতে হবে। কেননা এদেশে এসে তারা যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করবেন না- তার নিশ্চয়তা কে দেবে? এরা এমনিতেই আমাদের দেশের শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে আছে।'