রাতভর গোলাগুলি ও মর্টার শেলে কাঁপছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের আটটি গ্রাম। মিয়ানমারের সীমান্ত লাগোয়া এসব গ্রামের মানুষ আতঙ্কে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় ফাঁকা পড়ে আছে তুমব্রম্ন বাজার, বেতবুনিয়া বাজার, অনেক স্কুল ও মাদ্রাসা।
স্থানীয়রা জানান, গত সোমবার রাত ৯টা থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত অনবরত গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। এতে আতঙ্ক গ্রাস করে গোটা সীমান্ত এলাকাকে।
এদিকে মঙ্গলবার সকাল ৯টায় মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল এসে পড়ে ঘুমধুম ইউনিয়নের মধ্যমপাড়া মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বাড়ির পাশে। সেখানে ছৈয়দ নুর সিকদারের বাড়ির জানালার কিছু অংশ ফেটে গেছে। এতে কোনো হতাহত হয়নি বলে জানান ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টো।
তিনি আরও বলেন, 'প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবারও কোনো মানুষ কাজকর্মে বের হয়নি, দোকানপাট বন্ধ থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসও নিতে পারছে না স্থানীয়রা। এছাড়াও বিকালে রাইফেলের গুলিতে তুমব্রম্ন কোনার পাড়ার বাসিন্দা সৈয়দ আহমদ (৪০) গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। তার মাথায় গুলি লেগে রক্তাক্ত হয়। বর্তমানে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসারত রয়েছেন তিনি।'
মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে বিকাল পর্যন্ত ঘুমধুমের মধ্যমপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামে কয়েকজন পুরুষ ছাড়া কেউ নেই। নারী-শিশুরা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্রে অবস্থান নিয়েছে। সবার মধ্যে গোলাবারুদের ভয় কাজ করছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকুবুনিয়া সীমান্ত চৌকি দখলকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) মধ্যে গোলাগুলি হয়। পাশাপাশি মর্টার শেলের গোলা বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে আতঙ্ক বেড়ে যায় সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে।
বেতবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা এনামুল হক বলেন, এখন যতটুকু ভয় পাচ্ছে মানুষ, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও এত ভয় পায় নাই।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সোমবার দিবাগত রাতে সংঘর্ষ চলাকালে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অন্তত ৩৫ জন সদস্যকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে দেখা গেছে। তাদের ঘুমধুম তুমব্রম্ন বিওপি ক্যাম্পে
হেফাজতে রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে সীমান্তে উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে বিজিবি, পুলিশ টহল জোরদার করেছে।
অপরদিকে সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন বান্দরবান জেলা প্রশাসক মুজাহিদ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন। জেলা প্রশাসক সীমান্তের পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে।
বিজিবি জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ২৬৪ জন মিয়ানমারের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য বিজিবির ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে গুরুতর আহত ১৫ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিজিবির গণসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম।
সেনাসহ ২৬৪ জন পালিয়ে বাংলাদেশে
এদিকে মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সংখ্যা বাড়ছেই।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বলেছেন, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত তিন দিনে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মোট ২৬৪ জন বিজিবির হেফাজতে এসেছেন।
'তাদের মধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড পুলিশ-বিজিপির সশস্ত্র সদস্য যেমন আছেন, সাধারণ মানুষও আছে। কারা কতজন- এ সংখ্যাটা নির্ণয়ের চেষ্টা চলছে।'
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রম্ন সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইনে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহী আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে গত কয়েকদিন ধরেই।
শনিবার রাতে বিদ্রোহীরা বিজিপির একটি ফাঁড়ি দখল করে নিলে রোববার সকালে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১৪ সদস্য। এরপর তিন দিনে সেই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ২৬৪ জনে পৌঁছেছে।
তাদের নিরস্ত্র করে নিজেদের হেফাজতে নিচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। গুলিবিদ্ধ অন্তত ১৫ জনকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে বিজিপির চার সদস্যকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সোমবার রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
বিজিবির হেফাজতে থাকা এই ২৬৪ জনের বাইরে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর আরও কেউ বাংলাদেশে প্রবেশে করে কোথাও আশ্রয় নিয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে রাখাইনের বেশ কিছু চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের মানুষের মিয়ানমার- বাংলাদেশ সীমান্তের শূন্য রেখায় জড়ো হওয়ার তথ্য দিয়েছেন এপারে থাকা তাদের স্বজনরা। শূন্য রেখায় মানুষের জড়ো হওয়ার কিছু ভিডিও চিত্র সেখান থেকে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে বলেও তারা দাবি করেছেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, 'বিগত কয়েকদিন ধরেই সীমানার ওপারে রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে করে আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে শুনতে পারছি যে, সেখানে একটি মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় আমরা বিভিন্ন পয়েন্টে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছি।'
'সমস্যা হচ্ছে, এসব অনুপ্রবেশ যদি ঘটে, আমরা এমনিতেই ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গা নিয়ে গত ছয়-সাত বছর ধরে হিমশিম খাচ্ছি। এখন রাখাইন থেকে যদি আরও অনুপ্রবেশ করে তাহলে সেটি আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।'
তবে সীমান্ত সুরক্ষিত আছে দাবি করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রতিবেশী দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পালিয়ে আসা সদস্যদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা করছে সরকার।
'এখন কোন প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, সে নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনার মধ্যে আছি। তাদেরকে কি আকাশপথে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, নাকি পোর্টের মাধ্যমে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, সেটা নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনার মধ্যে আছি। আমরা একটা পথ বের করব।'
রাখাইনে সেনা ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের লড়াইয়ের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। আতঙ্কে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে থাকছেন।
সোমবার দুপুরে মিয়ানমার থেকে আসা গোলায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী এলাকায় নারীসহ দুজন নিহত হন।
ঘুমধুম ইউনিয়নের মধ্যমপাড়ায় মঙ্গলবার সকালেও একটি মর্টার শেল এসে পড়ে এক বাড়ির উঠানে। তবে সেখানে কেউ হতাহত হননি।
স্থানীয়রা বলছেন, এখনো তারা গোলাগুলি ও মর্টার শেলের আওয়াজ শুনতে পারছেন। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে গুলি হচ্ছে; আবার বিদ্রোহীরাও পাল্টা গুলি চালাচ্ছে।