বাজার নিয়ন্ত্রণে পণ্য আমদানির ছকে বাড়ছে অর্থনৈতিক ঝুঁকি
প্রকাশ | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ভরা মৌসুমে দাম না কমায় আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। হিলি স্থল বন্দরের ৫০ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অনুমতি পেয়ে এরই মধ্যে ভারত থেকে আলু আনতে শুরু করেছে। ফলে বন্দর এলাকায় কেজিতে আলুর দাম কমেছে ৫-৬ টাকা।
এর আগে, ডিমের দাম সরকারের বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যে রাখার উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর বিদেশ থেকে ডিম আমদানি করার অনুমতি দেওয়া হয়। ভারত থেকে আমদানি শুরুর পরপরই ডিমের দাম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। গত বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে টানা কয়েক সপ্তাহ কাঁচা মরিচের কেজি ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল বাজারে। দাম কমাতে সরকারের নির্দেশনা, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের অভিযান- কোনো পদক্ষেপেই যেন ঝাল কমছিল না মরিচের। শেষ পর্যন্ত জুলাই মাসের শুরুতেই সরকার কাঁচা মরিচ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ওই মাসের ৩ তারিখে ভারত থেকে আমদানি করা কাঁচা মরিচের ট্রাক বাংলাদেশের সীমান্তে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পাইকারি ও খুচরা বাজারে কাঁচা মরিচের দাম কমতে শুরু করে। একদিনেই কাঁচা মরিচের দাম প্রতি
কেজি ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় নেমে আসে।
কেবল আলু, ডিম আর কাঁচা মরিচই নয়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন চাল, পেঁয়াজ বা রোজার সময়ে ছোলা বা খেজুরের দাম বেড়ে গেলে এক পর্যায়ে সরকারকে সেসব পণ্য আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে। এতে নিত্য খাদ্যপণ্যের বাজার দ্রম্নত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।
বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে 'আমদানি কৌশলকে' সরকার সহজ ও দ্রম্নত কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরে নিলেও বিশেষজ্ঞ এবং বাজার পর্যবেক্ষকেরা এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। তাদের ভাষ্য, বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা এবং আমদানি নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। দাম কমাতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে আমদানি না করে, বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রম্নটিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনাগত ত্রম্নটির কারণে আলুর দাম অনিয়ন্ত্রিত। এরকম ক্ষেত্রে আমদানি করে সরবরাহ বাড়িয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা কঠিন। বাজারে সরবরাহের ঘাটতির কারণে পণ্য আমদানি করা হলে সেটি বাজারে তেমন প্রভাব ফেলে না। কিন্তু কৃত্রিমভাবে বাজারে পণ্যের যোগান নিয়ন্ত্রণ করা হলে, সেরকম ক্ষেত্রে আমদানি করার পদক্ষেপ হিতে বিপরীত হতে পারে।
এই গবেষক বলেন, এরকম পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক হয় না এবং দামও কমে না। তার ওপর আমদানি যথেষ্ট পরিমাণে হলে বড় ব্যবসায়ীরা তাদের হাতে থাকা পণ্য বাজারে ছেড়ে দিতে পারেন। ফলে সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি পণ্যের দাম কমলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।
যদিও বছরখানেক ধরে ডিম, চাল, পেঁয়াজ কিংবা ডালের মতো কোনো কোনো পণ্য, যেমন চিনি, লবণ বা সয়াবিন তেল হঠাৎ করে বাজার থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এরপর দাম বাড়ানো কিংবা আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ওই সব পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার ঘটনা দেখা গেছে।
তবে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে আমদানিই যেন বাজারের আগুন নেভানোর একমাত্র সমাধান। কিন্তু প্রকৃত অর্থে, যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে আমদানি নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে একটি বড় চিন্তার বিষয়। এর অর্থ হচ্ছে, প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের জন্য তখন অন্যের ওপর নির্ভর করতে এবং তার পেছনে দেশের আয়ের বড় অংশটি ব্যয় করতে হবে। এর ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ারও সম্ভাবনা থাকে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, দেশে অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই কতিপয় বড় ব্যবসায়ীরা পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে থাকেন। পণ্য আমদানি করা হলে তখন তারা দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পদক্ষেপ নিতে পারেন এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। অনেকে হয়তো ব্যবসা ছেড়ে দিতেও বাধ্য হতে পারেন।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে, উৎপাদন বাড়ানো এবং বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা। তাদের ভাষ্য, তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে, লম্বা সময় ধরে খাদ্যপণ্য আমদানি অব্যাহত থাকলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। তখন কতিপয় বড় ব্যবসায়ীর হাতেই এসব পণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে। এরকম পরিস্থিতিতে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে বাজারে ওইসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। এর ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যাবে।
এদিকে বাজার পর্র্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাজার থেকে 'কথিত সিন্ডিকেট'-এর প্রভাব কমাতেই সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্য আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। 'আমদানি কৌশল' কাজে লাগিয়ে সরকারও হাতেনাতে সুফল পাচ্ছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করা খাদ্যপণ্য আমদানি করে সিন্ডিকেটের হোতাদের শায়েস্তা করা যায়। সরাসরি সিন্ডিকেশন খোঁজার চেয়ে এভাবেই বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সহজ বিধায় সরকার এ পথ বেছে নিয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলেন, চাহিদা ও যোগানের প্রকৃত তথ্য না থাকার কারণেই বিভিন্ন পণ্যের বাজার বিভিন্ন সময় অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। যা সামাল দিতেই সরকারকে আমদানি কৌশলের ফাঁদে পা দিতে হয়। বাজার নিয়ন্ত্রণে চাহিদা ও সরবরাহের সঠিক তথ্য জরুরি বলে দাবি করেন তারা।
তাদের এ দাবি যে অমূলক নয়, তা আলুর বর্তমান বাজার দর এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর তথ্যের গরমিলের চিত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জানা গেছে, গত মৌসুমে দেশে আলুর উৎপাদন অভ্যন্তরীণ চাহিদার চেয়েও প্রায় ২৪ লাখ টনের মতো বেশি বলে জানিয়েছিল সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। এরপরও 'সংকট' দেখিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী আলুর দাম অস্বাভাবিক পর্যায়ে ধরে রেখেছে। ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শেষমেশ আমদানির ঘোষণা দিতে সরকার বাধ্য হয়েছে। এর পর থেকেই বাড়তি উৎপাদনের ওই সাফল্যের তথ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে।
উৎপাদন উদ্বৃত্ত হলে আমদানির প্রয়োজন হচ্ছে কেন- এমন প্রশ্ন বিশ্লেষকদেরও। তারা বলছেন, 'মিথ্যা সাফল্য' দেখাতে সব সময় বাড়তি উৎপাদনের তথ্য দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ বছরও সেটা হয়েছে, যা চলমান আলু সংকটের বড় কারণ। স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন বাড়লে দাম কমে আসে। অথচ উদ্বৃত্ত আলুর দাম চড়া পর্যায়েই রয়েছে। মানে অধিদপ্তরের হিসাবে গলদ আছে।
চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ার পরও আলু আমদানির সিদ্ধান্ত সঠিক পদক্ষেপ বলে মানতেও নারাজ ওইসব বিশ্লেষক। তারা বলছেন, মিথ্যা সাফল্য দেখাতে গিয়ে এ বছর আলু নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা ব্যাহত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সংকট থাকলেও সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ কারণেই সরকারি পদক্ষেপ কিংবা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মতো বিষয়গুলোও সুপরিকল্পিত ও নির্ভুল নয়। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে, ভবিষ্যতে কৃষকদেরও গুনতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গত আলু উৎপাদন মৌসুমের শেষে (২০২২-২৩ অর্থবছর) এক কোটি ১২ লাখ টন আলু উৎপাদনের তথ্য দিয়েছিল। এ উৎপাদনের তথ্য আবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) সঙ্গে মিলিয়ে চূড়ান্ত করতে হয়। পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত উৎপাদনের পরিমাণ বিবিএসে কম থাকায় ডিএই পরিসংখ্যান সামঞ্জস্য রাখতে উৎপাদন কমিয়ে এক কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার টন চূড়ান্ত করে। শেষ হিসাবেও অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় আলুর উৎপাদন প্রায় ২৪ লাখ টন বেশি হয়। কারণ দেশে প্রতি বছর সর্বোচ্চ ৯০ লাখ টন আলুর চাহিদা রয়েছে।
এসব বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রত্যেক মহাপরিচালক তার সময়ে প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে বলে দেখাতে চান। বাস্তবতাটা মানতে চান না। প্রোডাকশনে কোনো পণ্য কম হয়েছে, এটা বলতে নারাজ। এজন্য প্রতি বছরই দেখা যায় আমাদের উৎপাদন বাড়ছে আর বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবটা এটাই। আমি মনে করি এটা সঠিক নয়। এ বছর আলুর উৎপাদনও এভাবে বেশি দেখানো হয়েছে।