সীমান্তে উত্তেজনা-গোলাগুলি
মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেলে বাংলাদেশিসহ দুইজন নিহত
বাংলাদেশে প্রবেশ করা বিজিপির সদস্য সংখ্যা একশ' ছাড়িয়েছে
প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আবদুল হামিদ, নাইক্ষ্যংছড়ি, জাবেদ আবেদীন শাহীন, কক্সবাজার ও ফারুক আহমদ, উখিয়া
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুইজন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। সোমবার বিকাল পৌনে ৩টার দিকে ওই ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মর্টার শেলটি এসে পড়ে।
নিহত নারী জলপাইতলী গ্রামের বাদশা মিয়ার স্ত্রী হুসনে আরা (৫০)। আর নিহত রোহিঙ্গার নাম নুরুন্নবী। তিনি ক্যাম্প-৮ই এর ৭৩ নম্বর বস্নকের বাসিন্দা। তিনি বাদশা মিয়ার বাড়িতে কাজ করতেন।
এদিকে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে সোমবার দিবাগত রাত ৮টা পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ১০৬ জন সদস্য অস্ত্রসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এদের মধ্যে বিজিবির তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এ পর্যন্ত ৯ জনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, ঘুমধুম সীমান্তে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে মিয়ানমারের ৪০০ চাকমা। পাশাপাশি কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাও সীমান্তে জড়ো হচ্ছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ক্ষেতের কাজের ফাঁকে রোহিঙ্গা শ্রমিকসহ দুপুরের খাবার রান্না করছিলেন হুসনে আরা। এ সময় হঠাৎ বিকট শব্দে মর্টার শেল বিস্ফোরণ হলে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। আশেপাশের লোকজন এগিয়ে এলে রোহিঙ্গা শ্রমিককে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান।
সীমান্তের আশপাশের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রোববার রাত থেকে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ঢেঁকিবনিয়া থেকে তীব্র গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। সেখানে রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) বিজিপির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে হামলা চালালে লড়াই শুরু হয় বলে জানা গেছে। লড়াইয়ে উভয় পক্ষ মর্টার শেল, রকেট লঞ্চার, মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে। এর আগে রোববার বিজিপির আরেকটি চৌকি তুমব্রম্ন রাইট
ক্যাম্প আরাকান আর্মি দখল করে বলে জানা গেছে। ওই চৌকি থেকে ঢেঁকিবনিয়ার দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মান্নান জানান, নিহতদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষী ১০৬ : মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের যুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সশস্ত্র বিজিপি সদস্যের সংখ্যা একশ' ছাড়িয়েছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম সোমবার সকালে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, তখন পর্যন্ত মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৯৫ জন সদস্য অস্ত্রসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। পরে সোমবার দিবাগত রাত ৮টায় আরেক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ওই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৬ জনে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে।
হাসপাতালে ভর্তি গুলিবিদ্ধ ৯ বিজিপি
পালিয়ে আসা মিয়ানমার অভ্যন্তরে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ) এর ৭ জনকে উখিয়া এমএসএফ হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগে রোববার রাতে দুজনকে ভর্তি করা হয়। এই নিয়ে মোট ৯ জনকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কঠোর নিরাপত্তায় হাসপাতালে তাদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
গুলিবিদ্ধ হয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিজিপি সদস্যরা হলেন- রি লি থাইন, জা নি মং, নিম লাইন কিং, ক্যে থিন সিন, ইয়ো ফো, মং র, জা নি মং, মুলিউন থং, কিন মং জ। এ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজনকে কুতুপালংয়ের এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দুই সদস্য রোববার রাতে আহত অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে আনা হয়। এরপর সোমবার সকালে আরও সাতজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় ৪০০ চাকমা
এদিকে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে চলমান সংঘর্ষের মধ্যে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন দেশটির চাকমা সম্প্রদায়ের প্রায় ৪০০ জন। পাশাপাশি কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাও সীমান্তে জড়ো হচ্ছেন। তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান।
মো. মিজানুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মিয়ানমারে দেশটির সরকারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘর্ষ চলছে। এতে মিয়ানমার সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই অবস্থায় তারা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমার থেকে কোনো রোহিঙ্গা অথবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের লোকজন যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারেন, সে জন্য সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।
ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তে ব্যাপক গোলাগুলি
এদিকে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঢেঁকিবুনিয়া সীমান্তে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সশস্ত্র সংঘর্ষ চলছে। রোববার সন্ধ্যার পর থেকে রাত ২টা পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ধামনখালী সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঢেঁকিবুনিয়া এলাকায় ব্যাপক গোলাগুলি ও বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
পালংখালীর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, পালংখালী সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। তবে সকালের পর নতুন করে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি। তবে মানুষের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সোমবার সকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রম্ন সীমান্তে ২-৩টি গুলির শব্দ শোনা গেছে বলে জানিয়েছেন ঘুমধুম ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম।
এতে করে সীমান্তে এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন বলে ভুক্তভোগীরা জানান। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ বাড়ি থেকেও বের হচ্ছেন না। সীমান্ত এলাকার কয়েকটি বাজারে দোকানপাট প্রায় বন্ধ দেখা গেছে। এরমধ্যেও যারা বাজারে আসছেন তারাও দ্রম্নত বাড়ি ফিরছেন।
সীমান্ত এলাকায় পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কায়সার হামিদ কেবল বলেছেন, তিনি 'খোঁজ-খবর' নিচ্ছেন।
ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়া সাময়িক বিষয় :র্ যাব
এদিকে সোমবার দুপুরে সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন কক্সবাজারর্ যাব-১৫ ব্যাটালিয়নের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ছালাম চৌধুরী।
পরিদর্শন শেষে পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েক দিন ধরে যে উত্তেজনা শুরু হয়েছে সেটা এখনো চলমান রয়েছে। সেখানে বিজিবি কাজ করছে। তার পাশাপাশির্ যাব-পুলিশ বসে নেই। এই পরিস্থিতির মধ্যে উৎসুক জনতা এসব ঘটনা দেখার জন্য ঘর ছেড়ে রাস্তায় চলে আসে। এটা তাদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করি। এর মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে গুলি এখানে এসে পড়ে। এরই মধ্যে পড়েছেও। এজন্য তাদেরকে সতর্কীকরণ করা হচ্ছে যাতে তারা নিরাপদ জায়গায় থাকেন।'
স্থানীয়দের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার বিষয়ের্ যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, 'ঘরবাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে এটা সাময়িক একটা বিষয়। যখন একটা উত্তেজনা শুরু হয় তখন তারা অনেকে ভয়ে বিহ্বল হয়ে আরও বেশি ক্ষতি হবে কি না এই আশঙ্কায় ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। নিরাপত্তার ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশ রয়েছে; পাশাপাশি বিজিবি ওর্ যাব আছে। সব পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার করে যাচ্ছে।'
আবু ছালাম চৌধুরী বলেন, 'আরেকটা বিষয় হলো, তারা বিভিন্নভাবে (বিজিপি ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী) মেইন রোডে আমাদের মুভমেন্ট অবলোকন করছে। তবে তারা অবলোকন করল কী করল না- আমরা এটা আমলে নিই না। কিন্তু আমরা আমাদের দিক থেকে অত্যন্ত সবল আছি। তারা ইচ্ছে করলে এখানে চলে আসতে পারবে না। চলে এলেও আমরা যাতে ব্যবস্থা নিতে পারি সেভাবে সতর্ক আছি।'
'অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর বিজিবি'
এদিকে সোমবার সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বিজিবির কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোর্শেদ আলম। পরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে রোববার বিজিপি সদস্যদের অনুপ্রবেশ বিষয়ে বলেন, 'রোববার বিজিপি যখন কোনোভাবেই বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠছিল না তখন তারা আমাদের সীমান্তে অনুপ্রবেশ করতে চায়। তখন আমরা কর্তৃপক্ষকে জানাই এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা তাদের সেইফ প্যাসেজ দেই। তারা অস্ত্র ছেড়ে আত্মসমর্পণ করে। তাদের নিরাপদে রেখে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করি। তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সরকার কাজ করছে। আজ (সোমবার) দুজন মর্টারের আঘাতে নিহত হয়েছেন। আমরা তাৎক্ষণিক বিজিপির কাছে এর প্রতিবাদ জানিয়েছি।'
বিজিবি কর্মকর্তা আরও বলেন, 'আমাদের সীমান্ত সিল করা আছে। আমরা কোনোভাবেই রোহিঙ্গা বা অন্যদের এখানে অনুপ্রবেশ করতে দেব না। বিজিবি সেখানে কাজ করছে।'