উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালুর পর থেকেই যাত্রী সংকটে এই রুটে চলাচলকারী বাসগুলো। বিশেষ করে মিরপুর থেকে মতিঝিল, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী ও আজিমপুরগামী পরিবহণগুলোতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। গত জানুয়ারিতে মেট্রোরেল চলাচলের সময় বাড়ানোর পর এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে।
পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে লোকসানে রয়েছেন বাস মালিকরা। বাস বন্ধ করে দেয়াসহ অনেকেই ভাবছেন রুট পরিবর্তনের কথাও। তবে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে গণপরিবহণ হিসেবে বাসকে যাত্রীবান্ধব করতে হবে বলেও মনে করেন তারা। যদিও গত এক দশক ধরে এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও যাত্রী ভোগান্তী কমানো যায়নি। তবে লোকসানের চাপে এখন উন্নত সেবা দেওয়ার কথা ভাবছেন খোদ বাস মালিক ও এ খাতের উদ্যোক্তরা।
বর্তমান পরিস্থিতি: এই রুটের বাস মালিক ও চালকরা জানান, গত দুই সপ্তাহ ধরে সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মিরপুর থেকে মতিঝিল কিংবা যাত্রাবাড়ী গেছেন এমন যাত্রী সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন। এর বাইরেও এই রুটে যাত্রীর বড় একটি অংশ ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজারের। তা এখন কমে ১০ শতাংশে নেমেছে।
অন্যদিকে আজিমপুর কিংবা নিউমার্কেটগামী বাসের যাত্রী সংখ্যাও কমেছে উলেস্নখযোগ্য হারে। দেখা গেছে এই রুটের বেশিরভাগ যাত্রী এখন মেট্রো ব্যবহার করছেন। এসব যাত্রীরা শাহবাগ কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রো স্টেশনে নেমে গন্তব্য পৌঁছান। এছাড়া পল্টন সেগুনবাগিচা, পান্থপথ, এলিফেন্টরোড সায়েন্সল্যাব, মগবাজারগামী যাত্রীরাও বাসের বিকল্প হিসেবে মেট্রোরেল ব্যবহার করছেন।
এর আগে গত নভেম্বরের শুরু থেকে উত্তরা ও মতিঝিলের মধ্যে মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়। পরবর্তিতে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি এর সময় বাড়িয়ে রাত ৮টা ৪০ মিনিট করা হয়। দেখা গেছে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের ২০.১ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে মাত্র ৩১ মিনিট সময় লাগে। অথচ মিরপুর ১২ থেকে ছেড়ে আসা বাসগুলোর ১০ নম্বর গোল চত্বর পেরুতেই এর থেকে বেশি সময় লাগে। ফলে বেশিরভাগ মানুষ যাতায়াতের জন্য বাসের মতো গণপরিবহণের পরিবর্তে মেট্রোরেলকে বেছে নিয়েছেন। বর্তমানে দিনে এক লাখের বেশি যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করে। যা শীঘ্রই ২ লাখ
\হছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন দেখা গেছে মিরপুর ১২ থেকে ১০ নম্বর, আগারগাঁও, ফার্মগেট, জাতীয় প্রেস ক্লাব হয়ে মতিঝিল-যাত্রাবাড়ী এবং খামারবাড়ী, ২৭ নম্বর হয়ে সায়েন্সল্যাব ও আজিমপুর রুটে ৪ থেকে ৫টি প্রতিষ্ঠানের দেড়শতাধিক বাস চলাচল করে। কিন্তু ২০ জানুয়ারির পর থেকে যাত্রী সংকটে তা ১শর নিচে নেমেছে। তাদের হিসেবে ডিসেম্বরের তুলনায় যাত্রী কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। যদিও দু-একটি কোম্পানি তাদের বাসের সংখ্যা আগের মতোই রেখেছেন কিন্তু যাত্রী না থাকায় ডিপোতে কিংবা স্ট্যান্ডেই বসে থাকছে।
মিরপুর সুপার লিংক ও সেফটি পরিবহণের প্রায় ৫০টি বাস চলে মিরপুর থেকে আজিমপুর রুটে। এখন এই সংখ্যা বহাল থাকলেও ২০টির বেশি বাসের প্রয়োজন হচ্ছে না। সেফটি পরিবহণের চালক মো. রাকিব বলেন, বাস আগের মতোই আছে কিন্তু ট্রিপ কমেছে। আগে অফিস টাইমে ১০ নম্বর যাওয়ার আগেই বাস কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত। ৩টি স্ট্যান্ড মিলিয়ে কাঙ্ক্ষিত জন যাত্রী পাওয়া যায় না।
এদিকে যাত্রী না পাওয়ায় মিরপুরের প্রতিটি স্ট্যান্ডেই বাসগুলোকে দীর্ঘ সময় যাত্রীর অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। চালক রাকিব জানান, ১২ নম্বরে ১৫ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে মাত্র ৩ জন যাত্রী পেয়েছি। হয়তো পরের ২ স্টেশনে আরও ১০ থেকে ১৫ মিনিট দাঁড়ালে ১০ থেকে ১২ জন যাত্রী পাওয়া যেতে পারে। সকাল ১১টার পর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা এমনই থাকে বলে জানান অন্য চালকরাও।
একই অবস্থা মিরপুর থেকে গুলিস্তান, মতিঝিল, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী রুটের বাসগুলোর। শিকড়, বিকল্প, বিহঙ্গসহ আরও বেশকয়েকটি পরিবহণের বাস চলে এই রুটে। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক বাস নিয়মিত যাত্রী পরিবহণ করে থাকে। কিন্তু এখন অফিস আওয়ারে এবং রাত ৯টার পর কিছু যাত্রী পাওয়া গেলেও দিনের বেশিরভাগ সময় তীব্র যাত্রী সংকট থাকে।
বিহঙ্গ পরিবহণের চেয়ারম্যান নাসিরুদ্দীন খোকন বলেন, মেট্রোরেল চালু হওয়ায় যাত্রী সংকট তীব্র হয়েছে। যাত্রী সংকটে এখন তেলের পয়সাও উঠছে না বলে দাবি তার। মিরপুর থেকে সদরঘাট রুটে চলাচল করা এই পরিবহণের প্রায় ৬৫টি বাস রয়েছে। এতে কাজ করেন এমন পরিবহণ শ্রমিক প্রায় ৩শ' জন। কিন্তু আয় কমে যাওয়া এদের বেতন নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যাত্রীদের ওপর চালানো ২০২৩ সালের একটি জরিপের তথ্য বলছে, মেট্রোরেলে চড়া যাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৯.৪১ শতাংশ আগে মতিঝিল রুটে যাতায়াতের জন্য পাবলিক বাস ব্যবহার করতেন। জরিপে অংশ নেওয়া ১৪.৯৬ শতাংশ যাত্রী মেট্রোরেল চালুর আগে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ৬.৮০ শতাংশ মানুষের বাহন ছিল মোটরসাইকেল ও রিকশার যাত্রীর ছিলেন ৫.৩০ শতাংশ।
এই পরিস্থিতি স্বীকার করে নিয়ে বাসমালিকরা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে তারা পরিকল্পনা করছেন। বাস সংস্কার করা, সিটিং সার্ভিস চালুসহ যাত্রীবান্ধব বাস সেবা প্রদানে উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানান তারা। অন্যদিকে যাত্রী না পেয়ে অনেক বাস মালিক রুট পরিবর্তনের কথাও ভাবছে।
ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিকল্প পরিবহনের মালিক মাহাবুবুর রহমান বলেন, 'নতুন করে মেট্রোরেলের সময় বাড়ায় আমাদের আয় অর্ধেক কমে গেছে। এখন মিরপুরগামী রুটের বেশিরভাগ যাত্রী মেট্রোরেল ব্যবহার করছে। সামনে অবস্থা যদি আরও খারাপের দিকে যায় তাহলে অন্য রুটে বাস চালাতে হতে পারে।
তবে নতুন রুট পারমিট বেশ সময় সাপেক্ষ এবং জটিল। কারণ দেড় বছর ধরে আরটিসির (রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি) মিটিং বন্ধ। কমিটির নতুন নির্বাচনের আগে এই মিটিং হওয়ার সম্ভাবনাও নাই। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে বাসগুলোর যাত্রীসেবা মান উন্নত করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
নাসিরুদ্দীন খোকন বলেন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে বিকল্প ভাবতে হবে। মেট্রোরেলে তো সব যাত্রী চলাচল করতে পারবে না। তাই যাত্রী ধরে রাখতে আমাদের বাস ও সেবার মান পরিবর্তন করতেই হবে। নিয়মিত বিরতিতে বাস ছাড়া, যেখানে সেখানে যাত্রী না তোলা, মানসম্মত ও আরামদায় বাস নামানো ও পরিবহণ শ্রমিকদের সঠিক আচরণ নিশ্চিত করা গেলে যাত্রী পাওয়া যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
মিরপুর-মতিঝিল রুটে বাস মালিকদের আয় ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন কিছু কোম্পানি লোকসানের কারণে কার্যক্রম বন্ধও করে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে বাস অপারেটরদের সেবার মান উন্নত করার কোনো বিকল্প নেই। তবে মেট্রোরেলের দেওয়া সুবিধা ও দক্ষতার সঙ্গে পালস্না দিয়ে তা কতখানি কার্যকর করা যাবে সেটিই দেখার বিষয়।