প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) এবার আয়কর রিটার্ন দেননি। নির্ধারিত সময় থেকে দুই মাস বাড়িয়েও রিটার্ন জমাদানে উৎসাহিত করতে পারেনি রাজস্ব বিভাগ। তবে এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর দায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নয়, সরকারের।
এখনো সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা নিতে টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক হলেও রিটার্ন সার্টিফিকেট দেওয়া বাধ্যতামূলক হয়নি। তাই সবাই নামমাত্র টিআইএন খুলছে। আবার কিছু সেবা নিতে রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও সেখানে বাস্তবায়ন (এনফোর্সমেন্ট) নেই। সরকার যদি রিটার্ন সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করত, তাহলে সবাই রিটার্ন জমা দিত। তাই এ দায় সরকারকেই নিতে হবে।
জানা গেছে, বিদায়ী ২০২৩-২৪ করবর্ষে রিটার্ন জমা পড়েছে ৩৬ লাখ ৬২ হাজার, যা এর আগের ২০২২-২৩ করবর্ষে ছিল ৩০ লাখ ২৮ হাজার। আর ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ই-টিআইএন নিবন্ধন দাঁড়িয়েছে ৯৯ লাখ ৬৯ হাজার ৫১৫।
টিআইএনধারীর সংখ্যা যেখানে এক কোটি ছুঁই ছুঁই। সেখানে রির্টান জমা হয়েছে ৩৬ লাখ ৬২ হাজার। এর অর্থ হলো টিআইএনধারীর দুই-তৃতীয়াংশই রিটার্ন জমা দেননি। টিআইএনধারীর সংখ্যার বিবেচনায় যে পরিমাণ রিটার্ন জমা পড়েছে, তাকে সন্তোষজনক বলে মনে করছে না খোদ কর বিভাগ। এ বছর তারা অন্তত ৮০ লাখ রিটার্ন জমার আশা করেছিল।
রিটার্ন দাখিলের নিয়ম : টিআইএন রয়েছে তাদের জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক। তবে রিটার্ন দাখিল করলেই
যে আয়কর দিতে হবে, তা নয়। কারও আয় যদি করযোগ্য আয় না থাকে তাহলে কর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু রিটার্ন জমা দিলেই হবে। এরপরও রিটার্ন দেওয়ার সংখ্যা বাড়েনি।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই পাঁচ মাস জরিমানা ছাড়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া যায়। প্রতি বছর ৩০ নভেম্বর দেশে আয়কর দিবস হিসেবে পালিত হয়। এদিনই ব্যক্তি করদাতাদের আয়কর রিটার্ন জমার শেষ তারিখ। তবে করদাতাদের সুবিধার্থে প্রতি বছরই সাধারণত এই সময় বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। দুই মাস সময় বাড়িয়ে এবার রিটার্ন জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল ৩১ জানুয়ারি। কোম্পানির জন্য রিটার্ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১৫ জানুয়ারি থেকে বাড়িয়ে ২৮ ফেব্রম্নয়ারি করা হয়েছে।
রিটার্ন জমার হার
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের কাছ থেকে ট্যাক্স রিটার্নের মাধ্যমে ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আদায় হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি।
গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত রিটার্ন জমা পড়েছিল ৩০ লাখ ২৮ হাজারের কিছু বেশি। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে রিটার্ন জমা বেড়েছে প্রায় ৬ লাখ। পাশাপাশি রিটার্নের সঙ্গে আয়কর আদায় বেড়েছে প্রায় ৯০১ কোটি টাকা। যদিও জুন পর্যন্ত জরিমানা দিয়ে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে আরও কিছু রিটার্ন বাড়তে পারে।
জানা গেছে, দুই বছর আগে পর্যন্ত ৩৫ ধরনের সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে টিআইএন প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তাতে টিআইএন বাড়তে শুরু করলেও রিটার্ন তেমন বাড়ছিল না। এরপর এনবিআর ৩৮ ধরনের সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রম্নফ অভ সাবমিশন অভ রিটার্ন বা পিএসআর জমা নেওয়া বাধ্যতামূলক করে। গত বছর নতুন আয়কর আইনে এই সংখ্যা বাড়িয়ে ৪৩ করা হয়, অর্থাৎ এসব সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে পিএসআর দেখাতে হবে।
এনবিআর আশা করেছিল, এসব উদ্যোগের কারণে এবার অর্ধেকের কাছাকাছি টিআইএনধারী রিটার্ন জমা দেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এক-তৃতীয়াংশ জমা পড়েছে।
এবার ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া ২০২২-২৩ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন দাখিলের সুযোগ দেওয়া হয়। প্রতি করবর্ষে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জরিমানা ছাড়া রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এবার বিশেষ বিবেচনায় তা বাড়ানো হয়।
এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই'র অনুরোধে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাস সময় বাড়ানো হয়।
আয়কর আদায় পরিস্থিতি
এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫১ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা। এ খাতে এনবিআরের ঘাটতি ৮ হাজার ৫৯২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। লক্ষ্য অর্জনে আগামী ছয় মাসে এ খাত থেকে এনবিআরের রাজস্ব আদায় করতে হবে প্রায় ১ লাখ ২ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা।
সময় পার হওয়ার পর রিটার্ন দাখিলের নিয়ম
এখনো প্রায় ৬৫ লাখ করদাতা রিটার্ন জমা দেননি। এই করদাতাদের সম্পর্কে জানতে চাইলে এনবিআরের আয়কর অনুবিভাগ জানায়, কর দিবসের মধ্যে আয়কর রিটার্ন বা বিবরণী দাখিল করতে ব্যর্থ হলে গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ হারে জরিমানা দিতে হবে।
জানা যায়, গত বছর আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ বাতিল হয়ে এ বছর থেকে আয়কর আইন ২০২৩ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং এর ফলে ব্যক্তি করদাতার আয়কর গণনাসহ ট্যাক্স রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি করদাতা যদি কর দিবসের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে ব্যর্থ হতেন তাহলে মাসিক ২ শতাংশ সুদ দিতে হতো। এই সুদ বকেয়া করের ওপর গণনা করে রিটার্ন দাখিল করার সময় চালানের মাধ্যমে জমা দিতে হতো। তবে আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, এ বছর থেকে ২ শতাংশের পরিবর্তে মাসিক ৪ শতাংশ সুদ দিতে হবে। কোনো মাসের ভগ্নাংশও এক মাস হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমন কোনো করদাতা ৩১ জানুয়ারির মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে পারেননি। পরে তিনি ফেব্রম্নয়ারি মাসের ১০ তারিখে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। এক্ষেত্রে এক মাসের জন্য ৪ শতাংশ করে সুদ দিতে হবে।
রিটার্ন না দিলে কী অসুবিধা
কোনো করদাতা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে না পারলে অন্তত ৬ ধরনের সুবিধা পাবে না। যার মধ্যে রয়েছে কর অব্যাহতির সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন না অর্থাৎ তার যে কোনো ধরনের কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত আয় করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এছাড়া ওই করদাতা করমুক্ত আয়ের সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন না অর্থাৎ তার যে কোনো ধরনের করমুক্ত আয় করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচনা হবে। হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুবিধা প্রাপ্ত হবেন না। এছাড়া ওই ব্যক্তি কোনো ধরনের বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন না।
\হ
আইন অনুযায়ী জরিমানার বিধান
আয়কর আইন ২০২৩ এর ধারা ১৭৪ ও ২৬৬ অনুযায়ী তাকে অতিরিক্ত ও নির্ধারিত হারে জরিমানা পরিশোধ করতে হবে। আইন অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি সময়মতো আয়কর রিটার্ন দিতে ব্যর্থ হন, এক্ষেত্রে অধ্যাদেশ অনুযায়ী এক হাজার টাকা অথবা আগের বছরের করের ১০ শতাংশ জরিমানা করা যাবে। এ দুটির ভেতরে যেটি পরিমাণে বেশি সেই অঙ্কটি জরিমানা হতে পারে। এছাড়া কয়েক বছর ধরে যদি কেউ রিটার্ন দাখিল না করেন তাহলে ওই জরিমানা ছাড়াও যতদিন ধরে তিনি রিটার্ন দেননি ওই পুরো সময়ের দিনপ্রতি ৫০ টাকা করে জরিমানা হতে পারে। পুরনো করদাতা হলে আগের বছর যে পরিমাণ অর্থ আয়কর হয়েছে।
সেটিসহ ওই অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি দিতে হতে পারে। যারা করযোগ্য হওয়ার পরও একেবারেই কর দেন না, তাদের ক্ষেত্রে তিন ধরনের জরিমানা করা হয়। একটি হলো যে পরিমাণ কর বকেয়া হয়েছে সেটি ছাড়া আরও ২৫ শতাংশ বাড়তি জরিমানা, যে পরিমাণ কর বকেয়া তার ওপর ২ শতাংশ হারে মাসিক সরল সুদ ও যে পরিমাণ কর বকেয়া হয়েছে তার সমপরিমাণ জরিমানা।
বিশেষজ্ঞ মতামত
জানতে চাইলে এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ যায়যায়দিনকে বলেন, গত কয়েক বছর বিভিন্ন সেবা নিতে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্রের ক্ষেত্র বেড়েছে। এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই রিটার্ন জমা বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। এনফোর্সমেন্ট বাড়ানো উচিত। আমাদের পুরো ডাটাবেজটা ইন্টিগ্রেটেড করা উচিত, যাতে সহজেই এনবিআর দেখতে পারে কে রিটার্ন জমা দিয়েছে বা দেয়নি। এ বিষয়টি এনবিআরের পক্ষে সম্ভব নয়। যেসব সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে রিটার্ন দেওয়ার প্রমাণ দিতে হবে, সেটি সরকারের দায়িত্ব। সরকারের পক্ষেই সম্ভব এ হার বাড়ানো।
তিনি বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তের কারণেই টিআইএন বেড়েছে। কারণ টিআইএন না থাকলে অনেক সেবা পাওয়া যায় না। যেমন জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে অনেক সেবা পাওয়া যায় না। তাই রিটার্ন দেওয়ার বিষয়টিও সরকার উদ্যোগ নিলে বাড়বে।