স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণ, উত্তাল জাবি
ছাত্রলীগ নেতাসহ চারজনের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর. অভিযুক্ত ৬ জনের সনদ স্থগিত . তিন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার . চার সদস্যের তদন্ত কমিটি
প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শিহাব উদ্দিন, জাবি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে বহিরাগত এক নারীকে জঙ্গলে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রলীগের এক নেতা ও তার সহযোগীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় বিক্ষোভে উত্তল হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস। ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৬ জনের সনদ স্থগিত করে বিষয়টি তদন্তের জন্য ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। পাশাপাশি তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।
এদিকে, এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীর স্বামী জাহিদ বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/০৩) এর ৯(৩) ধারায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) আব্দুলস্নাহিল কাফি। এছাড়াও ঘটনায় মূল অভিযুক্তসহ চারজনকে আটক করে আশুলিয়া থানা পুলিশ। পরে তাদের আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত তাদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ধর্ষণ মামলায় মূল অভিযুক্ত হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি মীর মোশাররফ হোসেন হলের আবাসিক ছাত্র এবং শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। অন্য অভিযুক্তরা হলেন- ভুক্তভোগীর পূর্ব পরিচিত মামুনুর রশিদ মামুন, একই বিভাগ ও ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসানুজ্জামান, ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাগর সিদ্দিকী, মুরাদ এবং বোটানি ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান। এদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান, সাব্বির হাসান, সাগর সিদ্দিকী ও হাসানুজ্জামানকে গ্রেপ্তার
করেছে আশুলিয়া থানা পুলিশ। এছাড়া গ্রেপ্তারকৃতদের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে।
এর আগে, শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় মীর মোশাররফ হোসেন হল সংলগ্ন জঙ্গলে এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, শনিবার সন্ধ্যায় পূর্বপরিচিতির সূত্রে ভুক্তভোগীর স্বামী জাহিদকে (বাদী) বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে আনেন মামুন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে তাকে নিয়ে মীর মশাররফ হোসেন হলের 'এ' বস্নকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে (মুরাদের কক্ষ) নিয়ে আটকে রাখেন অভিযুক্তরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকদিন থাকবেন বলে জাহিদকে তার স্ত্রীর মাধ্যমে জিরানীর বাসায় নিজের রেখে আসা জিনিসপত্র আনতে বলেন মামুন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামুনের জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন ভুক্তভোগী নারী। পরে ওই নারীর কাছ থেকে জিনিসপত্র নিয়ে মামুন হলের ভিতরে মুরাদের কক্ষে সেগুলো রেখে আসেন। কক্ষ থেকে ফিরে এসে মামুন ওই নারীকে তার স্বামী হলের অন্য ফটক দিয়ে বের হবেন বলে মোস্তাফিজুরসহ হল সংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে যায়। পরে সেখানে তাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগী নারী।
ভুক্তভোগী নারী জানান, 'মামুন ভাই বলার পর আমি তার জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে যাই। মামুন জিনিসপত্রগুলো নিয়ে হলে রেখে আসে। পরে আমার স্বামী অন্যদিক থেকে আসবে বলে আমাকে হলের সামনে থেকে পাশের জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যায়। তার সাথে মোস্তাফিজ ভাইও ছিল। তখন তারা আমাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।'
এদিকে ধর্ষণের পর ভুক্তভোগী নারীকে ভয়ভীতি ও তার স্বামীকে মারধর করে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে অভিযুক্ত মোস্তাফিজ ও মামুন। তবে ঘটনাটি জানাজানি হওয়ায় প্রতিবাদস্বরূপ মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে জড়ো হতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে রাত ১টার দিকে ভুক্তভোগী নারীকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসে সাভার হাইওয়ে থানা পুলিশ। পুলিশ আসার খবরে হলের ডাইনিংয়ের রান্নাঘরের পেছনের তালা ভেঙে পালিয়ে যান অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর।
রান্নাঘরে থাকা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১টা ১৭ মিনিটে মোস্তাফিজুরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করছে ছাত্রলীগ কর্মী সাগর সিদ্দিকী, সাব্বির হাসান ও হাসানুজ্জামান। তবে রাতভর পালিয়ে থাকার পর রোববার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সাভার মডেল থানায় আত্মসমর্পণ করেন মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর। এছাড়া সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মোস্তাফিজুরকে পালাতে সহায়তাকারী তিনজনকে ভোর ৬টায় আটক করে আশুলিয়া থানা পুলিশ।
এ ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে রোববার দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলন করেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) আব্দুলস্নাহিল কাফি।
আব্দুলস্নাহিল কাফি বলেন, 'ভুক্তভোগীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে আসামিদের ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়।'
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ন্যক্কারজনক ঘটনায় জড়িতদের দ্রম্নত শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে রোববার দিনভর বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়কে পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে সাড়ে ১২টায় মিছিল নিয়ে প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল উপাচার্যের কক্ষের সামনে অবস্থান নেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে বাদী হয়ে মামলা এবং জড়িত সবার সার্টিফিকেট বাতিলের দাবি জানান।
নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা 'ধর্ষক ও সহযোগী, সমান অপরাধী', 'অছাত্র ধর্ষণ করে, প্রশাসন কী করে?' এসব সেস্নাগান দিতে থাকেন।
বিক্ষোভকারীদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রাসেল বলেন, 'ক্ষমতার ব্যবহার কারা করে, সেটা সবাই জানে। এই দায় প্রশাসনের, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিংবা বাইরে থেকে যারা ঘুরতে আসেন তাদের নিরাপত্তা কে দিবে? অবশ্যই প্রশাসন। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে যদি নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে এই প্রশাসনের থাকার দরকার নাই। যে ক্যাম্পাস আমার, সেই ক্যাম্পাস ধর্ষকের না।'
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া আরেক শিক্ষার্থী জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের তানজিনা আমান তানজুম বলেন, 'এই দায় সম্পূর্ণ প্রশাসনের। প্রশাসন যে অছাত্রদের এখনও হল থেকে বের করতে পারে না, সেই অছাত্ররাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। মনে হচ্ছে, প্রশাসন ধর্ষকদের পোষে।'
এছাড়াও ঘটনার পরপরই শাখা ছাত্রলীগ থেকে আবেদনের প্রেক্ষিতে মোস্তাফিজকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে দুপুর দুইটায় শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়কে মানববন্ধন করেন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন তার অনুসারীরা। এছাড়াও বিকাল চারটায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক সাব্বির আলম বলেন, 'ঘটনা শুনেই আমরা এসে বিস্তারিত জেনেছি। পুলিশ উপযুক্ত ব্যবস্থা নিবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তাদের সহযোগিতা করছি।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম বলেন, রাষ্ট্রীয় আইনে দোষীদের শাস্তি হবে। আমরা প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো।
৬ জনের সনদ স্থগিত, চার সদস্যের তদন্ত কমিটি
এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় ৬ জনের সনদ স্থগিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারও করা হয়েছে। রোববার সিন্ডিকেট সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া ঘটনার তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সনদ স্থগিত হওয়া শিক্ষার্থীরা হলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, একই বিভাগের মুরাদ হোসেন, শাহ পরান, মোস্তফা মনোয়ার সিদ্দিকী, মো. হাসানুজ্জামান ও এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান। তাদের মধ্যে শাহ পরান ছাড়া সবাইকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে মুরাদ, সাব্বির ও মোস্তফা মনোয়ার সিদ্দিকীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।
চার আসামির রিমান্ড মঞ্জুর
এদিকে ধর্ষণের অভিযোগে আশুলিয়া থানার মামলায় গ্রেপ্তার ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুরসহ চার আসামির তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
রোববার ঢাকার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাবেয়া বেগমের আদালত তাদের এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ডে নেওয়া অপর আসামিরা হলেন- সাব্বির হাসান, সাগর সিদ্দিক ও হাসানুজ্জামান।
এদিন তাদের আদালতে হাজির করে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক মিজানুর রহমান। অপরদিকে আসামি পক্ষে রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে শুনানি করা হয়।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের প্রতিবাদে ঢাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি। একইসঙ্গে 'জাবিতে ধর্ষণের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন বা কেবল ব্যক্তির অপরাধমূলক কোনো ঘটনা নয়; বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগকে এর দায় নিতে হবে' বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংগঠনের নেতারা।
রোববার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগ কর্তৃক সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ ও অপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে নেতাকর্মীরা এ হুঁশিয়ারি দেন।
গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আখতার হোসেনের সভাপতিত্বে এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব মো. নাহিদ ইসলামের সঞ্চালনায় বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব নুসরাত তাবাসসুম, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সদস্য সানজানা আফিফা অদিতি এবং আহ্বায়ক আসিফ মাহমুদ প্রমুখ।