আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে প্রথমপর্বের বিশ্ব ইজতেমা। গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগতীরে দেশ-বিদেশের নানা বয়সের মুসলিস্নরা এই মোনাজাতে অংশ নেন। এ সময় দেশের কল্যাণ, দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি কামনা করা হয়।
রোববার সকাল ৯টা থেকে এই আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন কাকরাইল মারকাজের তাবলিগ জামাতের শুরা সদস্য মাওলানা মো. জুবায়ের হাসান। আরবি, উর্দু ও বাংলা মিলিয়ে তিনি ২২ মিনিটে মোনাজাত শেষ করেন। ইজতেমা ময়দানের বিদেশি নিবাসের পূর্ব পাশের বিশেষ মোনাজাত মঞ্চ থেকে মোনাজাত পরিচালনা করা হয়। এই মোনাজাত টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
মোনাজাত শেষে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা-আশুলিয়া সড়ক, টঙ্গী-ঘোড়াশাল আঞ্চলিক সড়ক, টঙ্গীর কামারপাড়া-মন্নুগেট সড়কসহ আশপাশের সড়ক ও অলিগলিতে মানুষের ঢল নামে। কেউ বাসে, কেউ ট্রেনে, কেউবা হেঁটে বাড়ি ফিরতে শুরু করেন।
এর আগে ফজরের পর হেদায়েতি বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক। ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা কিছু সময় নসিহতমূলক বক্তব্য রাখেন। পরে সকাল ৯টা ১ মিনিটে শুরু হয় আখেরি মোনাজাত।
তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের মধ্যে বিভেদের কারণে এবারও বিশ্ব ইজতেমা হচ্ছে আলাদাভাবে। গত শুক্রবার আম বয়ানের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়।
এই পর্বে অংশ নেন কাকরাইল মারকাজের মাওলানা মো. জুবায়েরের অনুসারীরা,
যারা নিজেদের 'শুরায়ে নিজাম' বলতে পছন্দ করেন।
প্রতিবছর বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন কয়েক লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে তাবলিগ জামাতের বিদেশি অনুসারী থাকেন ৩০-৪০ হাজার।
তাবলিগ জামাতের নিয়মিত অনুসারী নন, এমন অনেকও বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শামিল থাকতে চান। সে কারণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকেই টঙ্গীর তুরাগ তীরে পৌঁছতে শুরু করেন শনিবার দুপুর থেকে। বাস, ট্রাক, কার, মাইক্রোবাস, ট্রেন, লঞ্চে করে এসে টঙ্গীতে পৌঁছে অবস্থান নিতে শুরু করেন তারা।
তাদের যাতায়াত সহজ করতে শনিবার রাত ১০টা থেকে গাজীপুরের তিনটি সড়কে ইজতেমাগামী যাত্রীদের যানবাহন ছাড়া সাধারণ যান চলাচল বন্ধ করে দেয় গাজীপুর মহানগর ট্রাফিক পুলিশ। সারা রাত ধরেই ইজতেমা ময়দানের পথে মানুষের স্রোত চলে।
ভোগড়া বাইপাস থেকে ইজতেমা মাঠের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। এই পুরো পথ হেঁটে অনেকে ইজতেমা মাঠের কাছাকাছি পৌঁছান।
ইজতেমা মাঠে জায়গা না পেয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, কামারপাড়া সড়ক, আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন হাজারও মানুষ। এতে ওইসব এলাকায় স্বাভাবিক যানবাহন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়।
গাজীপুরের সফিপুর থেকে আসা আবুল কালাম জানান, ভোর ৪টায় পিকআপে করে কালিয়াকৈর থেকে রওনা হয়ে ভোগড়া বাইপাস এলাকায় আসেন ভোর সাড়ে ৬টায়। কিছু সময় পরিবহণের জন্য অপেক্ষা করেন। পরিবহণ না পেয়ে অন্য অনেকের মতো হাঁটা শুরু করেন।
গাজীপুরের ভোগড়া এলাকা থেকে আসা মুজিবুর রহমান বলেন, তার বাড়ি ঝালকাঠিতে। তবে স্টারলাইট সোয়েটার কারখানায় চাকরি পাওয়ায় কিছুদিন ধরে ভোগড়া এলাকাতেই থাকেন। আগে ইচ্ছা থাকলেও ঝালকাঠি থেকে বিশ্ব ইজতেমায় আসা হয়নি তার। এবার যেহেতু গাজীপুরেই আছেন, আখেরি মোনাজাতে অংশ নেওয়ার সুযোগ হারাতে চাননি। পায়ে হেঁটে আসার কষ্ট তিনি ভুলে গেছেন মোনাজাতে অংশ নিতে পেরে।
ময়মনসিংহ থেকে আসা লোকমান মিয়া জানালেন, ভালুকা স্ট্যান্ড থেকে একটি মিনিবাসে করে তারা ২০ জন রওনা হয়েছিলেন রাত আড়াইটার দিকে। কুয়াশা আর শীত উপেক্ষা করে এসে তারা মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন।
নরসিংদী থেকে আসা জামাল হোসেন বললেন, 'আলস্নাহকে রাজি খুশি করতেই শীতের রাতে এই কষ্টটুকু করেও তৃপ্তি পাচ্ছি।'
আমাদের টঙ্গী প্রতিনিধি জানান, রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার লোকজনও শীত উপেক্ষা করে রাতেই টঙ্গীমুখো হন। মধ্যরাত থেকে টঙ্গীমুখী সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় ১৫ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটেও ইজতেমা মাঠে পৌঁছান অনেকে।
ইজতেমার মাঠে যাদের জায়গা হয়নি, আশপাশের বাসাবাড়ি, ভবন, ভবনের ছাদ কিংবা করিডোর, সড়কের পাশে ফুটপাতে এমনকি গাছতলায় এসে তারা মোনাজাতে হাত তুলেছেন।
মূল ইজতেমা ময়দানে নারীদের বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। সে কারণে ময়দানের বাইরে খালি জায়গায়, কলকারখানা ও বসতবাড়ির ছাদসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন বহু নারী।
আমাদের বিমানবন্দর/দক্ষিণখান প্রতিনিধি জানান, মোনাজাত শেষে ঢাকামুখী মুসলিস্নরা আব্দুলস্নাহপুর হয়ে উত্তরা হাউস বিল্ডিং, আজমপুর বিমানবন্দর সড়ক ধরে পায়ে হেঁটে চলতে শুরু করেন। যানবাহন না থাকায় হাজার হাজার মুসলিস্ন চরম ভোগান্তিতে পড়েন। বেলা যত বেড়েছে, কিছু কিছু যানবাহন টঙ্গী থেকে আসতে শুরু করে। কিন্তু সেসব বাহন ছিল মুসলিস্নদের ঠাঁসা, ছিল গেটলক। এরপরও যেতে হবে গন্তব্যে।
ঢাকামুখী রাস্তাগুলোতে তীব্র যানজট : এদিকে, পুলিশের ট্রাফিক গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজুর রহমান বলেন, 'মোনাজাত শেষে ঢাকামুখী রাস্তাগুলোতে স্রোতের মতো মানুষ হেঁটেছে। তাই আমরা এসব সড়কে যাত্রীবাহী যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করি।'
মো. শাকিল নামে এক গাড়িচালক বলেন, তার গাড়ি ব্যবহারকারী গুলশান ১ নম্বরে যাবেন। কিন্তু তিনি গাড়ি নিয়ে জাহাঙ্গীর গেটে এসে আটকা পড়েন। পরে তার গাড়ি ব্যবহারকারী নেমে হাঁটা দিয়েছেন। তিনি গাড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করছেন।
ফেসবুকের ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রম্নপে পোস্ট দিয়ে রাস্তার যানজটে অনেকক্ষণ আটকে থাকার কথা জানিয়েছেন অনেক মানুষ।
বুশরা তাবাসসুম নামে একজন লিখেছেন, 'আপনি ভাগ্যবান হলে কাকলী-বনানী পর্যন্ত গাড়িতে আসতে পারবেন। আর না হলে জাহাঙ্গীর গেটই আপনার লাস্ট স্টপেজ।'
এ এস এম লিথুন লিখেছেন, 'মেরুল বাড্ডা এলাকায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে রাস্তা আটকে দিয়েছে পুলিশ।
গুলশান-বনানী এলাকার জ্যাম ছড়িয়েছে হাতিরঝিলেও। হাতিরঝিলে অনেকক্ষণ ধরে আটকে থাকা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ মশিউর রহমান বলেন, 'মোটর সাইকেল নিয়েও কোনো দিকেই যেতে পারছি না। ইজতেমার বিষয়টি মাথায় ছিল না, তাহলে এ সময় অন্যদিকে যেতাম।'
ফেসবুকের ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রম্নপে সুদীপ্ত টি অর্ণব লিখেছেন, 'সকাল ৯-২৫ মিনিটে মহাখালী রাস্তার ওপর তিন সারিতে পার্ক করে রাখা হয়েছে বাসগুলো। কি একটা অবস্থা!'
সৌখিন পরিবহণ বাসের মালিক (অংশীদার) শেখ নুরুদ্দিন বলেন, টঙ্গীতে ইজতেমার কারণে তারা গাড়ি ছাড়তে পারেননি নির্দিষ্ট সময়। তবে তাদের কোম্পানির অনেক গাড়ি টঙ্গীতে ইজতেমায় আগতদের পরিবহণের জন্য ভাড়া করা হয়েছে।
১৯ জন মুসলিস্নর মৃতু্য : এবারের ইজতেমায় ১৯ জন মুসলিস্ন মৃতু্যবরণ করেছেন, যৌতুকবিহীন ৭২ যুগলের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে, প্রায় আট হাজার বিদেশি মেহমান ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছে মিডিয়ার সমন্বয়ক হাবিবুলস্নাহ।
দ্বিতীয় পর্ব শুরু ৯ ফেব্রম্নয়ারি : দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শুরু হবে আগামী ৯ ফেব্রম্নয়ারি। সেই পর্বের নেতৃত্ব দেবেন ভারতের দিলিস্ন মারকাজের মাওলানা সা'দ কান্ধলভীর অনুসারীরা। ১১ ফেব্রম্নয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা।