ওপারে গোলাগুলি, এপারে আতঙ্ক
দুই বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ, স্কুল ও সীমান্তে যানবাহন চলাচল বন্ধ, মিয়ানমার থেকে ৫৮ সীমান্তরক্ষী পালিয়ে বাংলাদেশে
প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আবদুল হামিদ, নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান)
মিয়ানমারের স্বাধীনতাকামী আরাকান বাহিনীর সঙ্গে দেশটির জান্তা বাহিনীর প্রচন্ড গোলাগুলিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
শনিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত প্রায় ১১ ঘণ্টা ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রম্ন সীমান্তে থেমে থেমে গুলি ও মর্টার বর্ষণ চলে। বোমা বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি গুলি ও মর্টার শেল বাংলাদেশে এসে পড়ে। এতে দুইজন বাংলাদেশি গুলিবৃদ্ধি হন। এ ঘটনার পর বান্দরবান জেলা প্রশাসন ৫টি স্কুল ও সীমান্ত এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ ঘটনায় আতঙ্কে ঘর ছেড়েছে ৩ গ্রামের হাজারো মানুষ।
আহতরা হলেন- কোনার পাড়ার বাসিন্দা প্রবীন্দ্র ধর (৫০)। পিতা জোতিষ্ট ধর ও রহমা বেগম (৪০)। আহতদের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর উন্নত চিকিৎসা। এদিকে বিদ্রোহী গ্রম্নপের ব্যাপক গোলাগুলির কারণে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ বিজিপির ৫৮ জনেরও বেশি সদস্য বাংলাদেশের ভূখন্ডের তুমব্রম্ন বিজিবি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে বাহিনীটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম। সীমান্ত পথে আরও ৩০ জনেরও বেশি বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে ঢোকার জন্য অবস্থান নিয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
শনিবার রাত ৩টা থেকে ব্যাপক গুলি বর্ষণের পাশাপাশি, মর্টার শেল নিক্ষেপ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ করছে। এতে সীমান্তের বাজার ঘাট বন্ধ রয়েছে। মিয়ানমারের তুমব্রম্ন রাইট ক্যাম্পের চারপাশে বিদ্রোহী গ্রম্নপ আরকান আর্মি ঘিরে রেখেছে এবং বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট বিদ্রোহী গ্রম্নপ আরকান আর্মি দখলে নিয়েছেন।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানিয়েছেন, মিয়ানমারের বিজিপির কিছু সদস্যরা তুমব্রম্ন সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সীমান্তে লাগুয়া স্কুলগুলো আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবি নিরাপত্তা বাড়িয়েছে সীমান্তে। নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বিজিবি।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, সীমান্তে যাতে অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে প্রশাসন থেকে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সীমান্তের দিকে নজর রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
উলেস্নখ্য, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির সাথে সে দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলছে। এ সংঘর্ষের জের ধরে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রম্ন সীমান্তেও উত্তেজনা চলছে। মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা দখল করে নিয়েছে মিয়ানমারের তুমব্রম্ন ক্যাম্পটি।
এদিকে বর্তমানে সীমান্তজুড়ে টান টান উত্তেজনা বিরাজমান। সীমান্তজুড়ে চলছে আতংক। মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে।
পাঁচটি বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা
এদিকে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তীব্র গোলাগুলির কারণে পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ও সীমান্তবর্তী কয়েকটি সড়কের যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
রোববার দুপুরের বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, শনিবার রাত থেকে হঠাৎ গোলাগুলি বেড়ে যায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে ঘুমধুম ও তুমব্রম্ন সীমান্তের কাছে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ হওয়া বিদ্যালয়গুলো হলো- বাইশফাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রম্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রম্ন পশ্চিমকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
নাইক্ষ্যংছড়ির প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ত্রি রতন চাকমা বলেন, শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে স্কুল খোলা হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্র আরও জানায়, ঘুমধুম ও তুমব্রম্ন সীমান্ত ঘেঁষে যে সড়কগুলো গেছে, সেগুলোয় প্রাইভেট কার না নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। গণপরিবহণ চলাচলও সীমিত করা হয়েছে।
ওদের ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
মিয়ানমারের ভেতরে ভয়াবহ গোলাগুলির মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) ১৪ জন সদস্যকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
রোববার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন মন্ত্রী। বাংলাদেশের বান্দরবানের তমব্রম্ন সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে ভয়াবহ গোলাগুলি চলছে। ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলমান গোলাগুলিতে কম্পিত পুরো সীমান্ত এলাকা। গোলাগুলির ভয়াবহতা দেখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন মিয়ানমারের ১৪ জন বিজিপি সদস্য।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'বিজিপির একের পর এক ঘাঁটি দখল করে নিচ্ছে আরাকান আর্মি। আমাদের বর্ডারের কাছে যেগুলো ছিল সেগুলো দখল করে নিয়েছে। বিজিপি আত্মরক্ষার্থে ভেতরে ঢুকে সহযোগিতা চেয়েছে। বিজিবি তাদের অবরুদ্ধ করেছেন তাদের অস্ত্র নিয়ে এক জায়গায় আটক করে রাখা হয়েছে। এরা মোট সংখ্যায় ১৪ জন।'
তারা আত্মরক্ষার্থে বাংলাদেশে ঢুকেছে জানিয়ে আসাদুজ্জামান খান বলেন, 'পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। যাতে তারা এদের নিয়ে যান।'
মন্ত্রী বলেন, 'পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমি আশা করি, খুব শিগগির এদের পাঠিয়ে দেবো।'
'আমরা কোনো যুদ্ধে জড়াতে চাই না। যুদ্ধ চাইও না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমাদের সবসময় সেই নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তবে আমরা সবসময় তৈরি আছি।'
তিনি বলেন, 'আমরা মিয়ানমার সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করেছি। আমরা পুলিশকে বলে দিয়েছি, কোস্টগার্ডকেও আমরা নির্দেশনা দিয়েছি। যাতে কোনোভাবেই কেউ আমাদের সীমানায় অনুপ্রবেশ করতে না পারে। সেই ব্যাপারে আমরা খুব সতর্ক রয়েছি। যুদ্ধ কতদিন চলে আমরা জানি না। কিন্তু সীমান্ত পার হয়ে কাউকে আসতে দেবো না। বিজিবিকে আমরা সেই নির্দেশনাটাই তাই দিয়েছি।'
আত্মরক্ষার্থে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী বাংলাদেশে ঢুকলে তাদের ধরে আবার ফেরত পাঠানো হবে বলেও জানিয়েছেন আসাদুজ্জামান খান।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এ দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রতিবন্ধকতা হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, 'তারপরও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সরকারের সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।'