বায়ান্নর ফেব্রম্নয়ারি ছিল এক অগ্নিগর্ভ মাস। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম স্ফূরণ ঘটে এ মাসেই। ভাষার দাবিতে চলমান আন্দোলন ছড়িয়ে রাজপথ থেকে রাজধানীর প্রতিটি অলি-গলিতে। ৪ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরে।
সেদিন গোটা শহরজুড়েই ছিল মিছিলের স্রোত। প্রতিবাদী চেতনার এক আলোকময় বিচ্ছুরণ। এক কথায় ভাষার দাবিতে এই দিনে মিছিলে মিছিলে ঢেকেছিল ঢাকা। এর আগে ৩১ জানুয়ারি বিকালে ঢাকার বার লাইব্রেরিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব। আর আব্দুল মতিন (ভাষা মতিন) ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক।
সভায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দুজন করে প্রতিনিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিটি হল থেকে দুজন করে প্রতিনিধি ছিলেন। এতে ২১ ফেব্রম্নয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর আসে ৪ ফেব্রম্নয়ারি, ১৯৫২। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরের সব স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী উর্দুকে পাকিস্তানে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা এবং আরবি হরফে বাংলা ভাষার প্রচলনের চেষ্টার প্রতিবাদে ধর্মঘট পালন করে। এদিন সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সভা শেষে হলে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী মিছিল করেন গোটা শহরজুড়েই।
এদিনের এই ধর্মঘট ও বিক্ষোভ গণমাধ্যমে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। শিক্ষার্থীদের সেদিনের মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর ঘুরে বেলতলায় এসে শেষ হয়। সেখানে প্রদেশব্যাপী
২১ ফেব্রম্নয়ারি ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান জানানো হয়।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল আরও আগেই। নানা শোষণ বঞ্চনার পর শাসকগোষ্ঠী আক্রমণ করে মাতৃভাষা বাংলা ভাষার ওপর। তবে ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার পর শুরু হওয়া আন্দোলন ৪ ফেব্রম্নয়ারি একটি দাবানলে রূপ নেয়। মূলত ১৯৫২ সালের পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ঢাকায় এসেছিলেন এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। পরে ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সরকার পূর্ব বাংলার জন্য কী কী করেছে তা উলেস্নখ করে বক্তৃতা করেন তিনি। বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে তিনি ঘোষণা করেন, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। খাজা নাজিমুদ্দিনের এই মন্তব্যটুকুই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দাবানল সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট ছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।