'টাঙ্গাইল শাড়ি'র উৎপত্তি ভারতে দাবি করায় এদেশে বিস্ময় ও বিতর্ক
প্রকাশ | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বিবিসি বাংলা
'টাঙ্গাইল শাড়ি' বাংলাদেশে বহুল পরিচিত একটি বিষয়। ঢাকার কাছে টাঙ্গাইল জেলার সঙ্গে এর নাম জড়িয়ে আছে। কিন্তু সম্প্রতি ভারত দাবি করেছে 'টাঙ্গাইল শাড়ি' তাদের পণ্য। বিষয়টিতে বাংলাদেশে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ভারত সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য উলেস্নখ করা হয়। বলা হয়, এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বহিঃপ্রকাশ।
ওই পোস্টের নিচে অনেক বাংলাদেশি ব্যবহারকারীকে প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়। তাদের বক্তব্য টাঙ্গাইল বাংলাদেশের একটি জেলার নাম এবং ওই শাড়িটির উৎপত্তি এই জেলায়।
কিন্তু এই বিতর্কের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে আরও এক মাস আগে।
চলতি বছরের জানুয়ারির দুই তারিখে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস বিভাগের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
সুন্দরবনের মধুও এই রাজ্যটির নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রির তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তশিল্প বিভাগ এর জন্য আবেদন করেছিল ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে।
টাঙ্গাইল শাড়িকে ধরা হয় নদীয়া ও পূর্ববর্ধমানের পণ্য হিসেবে। একইসঙ্গে মুর্শিদাবাদের গরদ ও করিয়াল নামে আরও
দুটি শাড়িও যুক্ত হয় জিআই নিবন্ধিত তালিকায়।
পাঁচ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এসব শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা দেন।
বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবশ্য জিআইর তালিকায় টাঙ্গাইল শাড়ির উপস্থিতির কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তিস্থল
বিভিন্ন গবেষণা এবং এই শিল্পের আদি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্তদের বয়ানে এই শাড়ির উৎপত্তিস্থল হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে উঠে আসছে পাথরাইল, নলশোধা, ঘারিন্দাসহ টাঙ্গাইলের এমন বাইশ-তেইশটি গ্রামের নাম।
একসঙ্গে বাইশগ্রাম বলে চিহ্নিত করা হতো। এসব গ্রামই ঠিকানা ছিল তাঁতিদের। যাদের পদবি ছিল 'বসাক'।
বলছিলেন হরিপদ বসাক, যিনি ওই তাঁতিদের বংশধর। জন্ম ও বেড়ে ওঠা 'পূর্ব বাংলায়' হলেও বর্তমানে বসবাস করছেন পশ্চিম বঙ্গের নদীয়ায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের ব্রিটিশ ভারতে টাঙ্গাইল ছিল ময়মনসিংহ জেলার এক মহকুমা।
হরিপদ বসাক জানান, '১৮৫০ সাল বা তার কাছাকাছি সময়ে তৎকালীন ধামরাই এবং চৌহট্ট নামে দুটি গ্রামে মসলিনের উত্তরসূরি কিছু তাঁতি বসবাস করতেন।
সন্তোষ, করটিয়া, দেলদুয়ারে জমিদারি পত্তনের সময় অন্যান্য পেশাজীবীদের পাশাপাশি ওই তাঁতিদেরও সেসব জায়গায় নিয়ে বসতি স্থাপন করা হয়।
এসব গ্রামের মানুষরা যে শাড়ি বয়ন করতেন তাই 'টাঙ্গাইল শাড়ি' নামে পরিচিতি লাভ করে।
নদীয়া বা পূর্ব বর্ধমানে প্রচলন যেভাবে
২০১৪ সালে টাঙ্গাইল জেলার তাঁতিদের নিয়ে একটি গবেষণা করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক সুব্রত ব্যানার্জি, মো. মনিরুজ্জামান মুজিব ও সুমনা শারমিন।
গবেষণায় দেখা যায়, পাকিস্তান পর্বে তো বটেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও বসাক সম্প্রদায়ের পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে।
নলশোধা গ্রামের উদাহরণ টেনে উলেস্নখ করা হয়, স্বাধীনতার পর পুরো গ্রামেই বাড়িতে বাড়িতে তাঁত থাকলেও ২০১৪ সালে সরেজমিন তারা দেখতে পান মাত্র ২২টি পরিবার এই পেশায় যুক্ত আছে।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁতশিল্প নিয়ে গবেষণা করেন নিলয় কুমার বসাক। তিনিও ওই তন্তুবায় সম্প্রদায়ের উত্তর প্রজন্ম।
নিলয় বলেন, '১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বসাক সম্প্রদায়ের বড় অংশই ভারতে চলে যায়। তাদের ভিড়টা বেশি হয় নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রাম এবং পূর্ব বর্ধমানের ধাত্রী গ্রাম ও সমুদ্রগড়ে।'
তাদের বদৌলতে নদীয়া ও পূর্ব-বর্ধমানে 'টাঙ্গাইল শাড়ি' পরিচিতি লাভ করে।
হরিপদ বসাকও প্রায় একই রকম তথ্য দেন। সঙ্গে যুক্ত করেন, 'এই বিদ্যেটা জানা ছিল বলে আমাদের উদ্বাস্তু জীবনের বোঝা বইতে হয়নি।'
জিআইর সম্পর্ক স্থানের সঙ্গে না ব্যক্তির সঙ্গে?
২০১১ সালেও একবার টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য জিআই আবেদন করা হয়েছিল বলে জানান হরিপদ বসাক। বলেন, 'সেই আবেদনটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল।'
তারপরও চেষ্টা চালিয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। ফল পেয়েছে ২০২৪ সালে এসে।
কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইলের নাম ধারণ করার পরও ভৌগোলিকভাবে অন্য স্থানের পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি না?
এর জবাবে, হরিপদ বসাক সামনে নিয়ে আসছেন পশ্চিমবঙ্গেরই বালুচরী শাড়ির উদাহরণকে।
তার ভাষ্য, 'অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে মুর্শিদাবাদ জেলার বালুচর নামক স্থানে এই শাড়ির জন্ম হলেও পরবর্তীকালে বন্যার কারণে বালুচরী তাঁতিরা বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে চলে আসেন। পরবর্তীতে সেখানে এই শাড়ির প্রসার ঘটে।'
'স্থানান্তরিত হলেও বালুচরী শাড়ি 'বিষ্ণুপুরি' বা অন্য কোনো নাম পরিগ্রহ করেনি বরং বালুচরী নামেই জিআই পেয়েছে।' বলেন এই তাঁতশিল্প গবেষক।
আর নিলয় বসাক উলেস্নখ করেছেন, 'দেশভাগের বলি হয়ে ভারতে চলে এলেও 'টাঙ্গাইল' শব্দটি ছিল বসাক তাঁতিদের অস্থিমজ্জাগত। ফলে উদ্বাস্তু এই তাঁতিরা নিজেদের বয়নীকৃত শাড়ির নাম বা বয়ন কৌশল পরিবর্তন করার কথা কল্পনাও করেননি।'
কিন্তু এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেন বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন, বিসিকের বিপণন শাখার মহাব্যবস্থাপক অখিল রঞ্জন তরফদার।
ঢাকাই জামদানি, রংপুরের শতরঞ্জি ও শীতলপাটির মতো পণ্যগুলোর জিআই প্রাপ্তির সময় এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অখিল রঞ্জন।
তিনি এ খবরে 'বিস্মিত' হয়েছেন বলে মন্তব্য করে বলেন, এটা যৌক্তিক নয়। এটার নামই কিন্তু জিওগ্রাফিক্যাল, অর্থাৎ ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে এই পণ্যটার একটা স্বীকৃতি।
'এখানে ব্যক্তির কোনো বিষয় নেই। যারা আগে চলে গেছে, তারা এমন দাবি করে করলে এটা একটু খটকাই লাগে', যোগ করেন বিসিকের এই কর্মকর্তা।
বলেন, 'শাড়িটার যেহেতু টাঙ্গাইলেই উৎপত্তিস্থল, এখানেই উৎকর্ষ। এই স্থানের ভিত্তিতেই কিন্তু এটার স্বীকৃতি হওয়া উচিত।'
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সুব্রত ব্যানার্জি ও সুমনা শারমিনও এই ধারণাটাকেই সমর্থন করেন।
অবশ্য, নিলয় কুমার ও হরিপদ বসাকও এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকে যায় বলে মনে করেন।
দুই দেশের শাড়ির বৈশিষ্ট্যে কী ফারাক
তাঁতশিল্পী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, টাঙ্গাইলের শাড়ির সুতা মিহি ও চিকন হয়।
সুতা টেকসই হয়, ফলে দীর্ঘদিন ব্যবহার নৈমিত্তিক ব্যবহারের উপযোগী থাকে।
এ ধরনের শাড়ি তপ্ত আবহাওয়ায়ও আরামদায়ক হয়।
তাঁতিদের স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শাড়িতেও বিভিন্ন পরিবর্তন যুক্ত হয়েছে বলে জানালেন হরিপদ বসাক।
তিনি বলছেন, 'টাঙ্গাইল ঘরানার ওপর কাজ করে এটাতে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কালার বা ডিজাইনে ঘটানো হয়েছে পরিবর্তন।'
বাংলাদেশের বাজার ভারতের শাড়িতে সয়লাব বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী নাজমুল হাসান।
ভারত থেকে যেসব 'টাঙ্গাইল শাড়ি' আসে সেগুলো একটু 'সিল্ক টাইপের' হয় বলে মত দেন তিনি।