বিশ্বের প্রাণঘাতী রোগের মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ রোগ ক্যানসার। এ রোগের উপসর্গ ঠিক বুঝে ওঠার আগেই এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে। আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার'র (আইএআরসি) হিসাব অনুযায়ী-২০২২ সালে বিশ্বে ২ কোটি নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়েছেন এবং ৯৭ লাখ মানুষ মারা গেছেন। সংস্থাটির অনুমিত হিসাব বলছে, এ বছরে বাংলাদেশে ক্যানসারে মৃতু্যর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮। আর গবেষণা বলছে. দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়ছে। আর তামাক ব্যবহারের উচ্চ প্রবণতা এই রোগে আক্রান্ত ও মৃতু্য পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে। তামাকের ধোঁয়ায় প্রায় ৭ হাজার রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যার মধ্যে ৭০টি ক্যানসার সৃষ্টিকারী। এগুলো ফুসফুস,
\হশ্বাসতন্ত্র এবং মুখের ক্যানসারসহ অন্তত ১২ ধরনের ক্যানসার সৃষ্টি করে। পরোক্ষ ধূমপানেও ক্যানসার হতে পারে। শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তামাক ব্যবহারজনিত ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আর দেশের এমন বাস্তবতায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যানসার দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য 'ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ' অর্থাৎ 'ক্যানসার চিকিৎসায় বৈষম্য বন্ধ করুন'।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত ও মৃতু্যর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও ধূমপানকে ফুসফুস ক্যানসারের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটির মতে, তামাক ব্যবহার পরিহারসহ অন্যান্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ক্যানসারে মৃতু্য ঝুঁকি ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব।
গেস্নাবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৮১ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন রোগে ভোগেন এবং তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃতু্য হয়। স্বাস্থ্যগতভাবে পরোক্ষ ধূমপান মারাত্মকভাবে ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে মানুষ আক্রান্ত হয় ফুসফুসের ক্যানসারে। এ ছাড়া তামাকের কারণে বিভিন্ন জটিল অসংক্রামক রোগ যেমন- হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়ে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, গর্ভাবস্থায় মহিলাদের ধূমপান 'সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম' (ঝওউঝ) বা শিশুর আকস্মিক মৃতু্যর ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া যেসব শিশু জন্মের পর পরোক্ষ ধূমপানের সংস্পর্শে আসে তাদেরও আকস্মিক মৃতু্যর ঝুঁকি বেশি থাকে এবং ফুসফুসে নিকোটিন ও কোটিনিন উচ্চ মাত্রায় থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া শিশুর আচরণগত সমস্যা হয় এবং শেখার ক্ষমতা হ্রাস পায়।
এদিকে, ২০১৯ সালে প্রকাশিত 'ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ' শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানোসহ) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয়ও বেশি
চিকিৎসকরা জানান, ক্যানসার মানসিকভাবে ক্লান্তিকর এবং অনেকের জন্য এটি আর্থিকভাবে ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা, রোগশয্যা-সম্পর্কিত নিদানবিদ্যার এবং চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা, চিকিৎসক এবং রোগীর মধ্যে যোগাযোগের অভাব, দেশীয় চিকিৎসকদের প্রতি তুলনামূলক কম আস্থা, বিভিন্ন চিকিৎসার মতামত নিয়ে বিভ্রান্তি, প্রশিক্ষিত ক্যানসার বিশেষজ্ঞের এবং চিকিৎসা সুবিধার অভাব এবং বিদেশে চিকিৎসার জন্য ক্রমবর্ধমান পর্যটন- এসব কারণে এখন বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীদের জন্য পরিপূরক সেবা সরবরাহ করা অনেক প্রয়োজন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'পরিস্থিতি বুঝে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হলে সব আগে হাসপাতাল ও জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রোগী নিবন্ধন জরুরি, যা এখন পর্যন্ত দেশে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি ও গবেষণা ইনস্টিটিউট পাইলট প্রজেক্ট নিয়ে চেষ্টা করছে। এটিও সন্তোষজনক নয়।]
তিনি বলেন, 'দেশে বস্নাড ক্যানসারের বাইরে অন্য ক্যানসারের অস্ত্রোপচারের জন্য সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট আছে। জেলা পর্যায়ে চিকিৎসক রয়েছেন। ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৯০ ভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে ওষুধ উৎপাদন ও কিছু ওষুধ বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে। তবে ক্যানসারের রেডিওথেরাপি চিকিৎসার জন্য ৩০০টি মেশিন দরকার হলেও এ মুহূর্তে দেশে সরকারিভাবে ২২টি এবং বেসরকারিভাবে ১৮টি রেডিওথেরাপি মেশিন আছে। সরকারি মেশিনগুলোর এক দুই-তৃতীয়ংশই বেশিরভাগ সময় অকেজো থাকে। এতে রোগী বিপাকে পড়ছে।'
বিশ্ব ক্যানসার দিবসের প্রতিক্রিয়ায় গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা'র (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'খসড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রম্নত চূড়ান্ত করতে হবে। এটি যত বিলম্বিত হবে ক্যানসারসহ তামাক ব্যবহারজনিত বিভিন্ন রোগে মৃতু্য ততই বাড়তে থাকবে।'
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের ৪টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো প্রাথমিক প্রতিরোধ, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সূচনায় ক্যানসার নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রশমন সেবা বা পেলিয়েটিভ চিকিৎসা। তাই ক্যানসার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
প্রসঙ্গত, ২০০০ সালের ৪ ফেব্রম্নয়ারি প্যারিসের নিউ মিলেনিয়াম শহরে আয়োজিত হয় বিশ্ব ক্যানসার কনফারেন্স। ওই সালেই ক্যানসারের বিরুদ্ধে প্রথম বিশ্ব সম্মেলনে বিশ্ব ক্যানসার দিবস হিসেবে এই দিনটি বেছে নেওয়া হয়। এদিন সারাবিশ্ব থেকেই বিভিন্ন দেশের ক্যানসার সংস্থার কর্তারা এই সম্মেলনে যোগ দেন। ক্যানসার প্রতিরোধে প্যারিস সনদও সাক্ষরিত হয় এই বিশেষ সম্মেলনে। মোট দশটি ধারার এই সনদে ক্যানসার রোগীর বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ও তাদের জীবনযাপন উন্নয়নের অঙ্গীকার নেওয়া হয়।