সীমান্তে মর্টার শেল-গুলির শব্দে আতঙ্ক

সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে বিজিবি, ফের রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা

প্রকাশ | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

আবদুল হামিদ, নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান)

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধু্যষিত এলাকায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির সরকারবিরোধী গ্রম্নপ আরাকান আর্মির লড়াই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আর এই লড়াইয়ের জেরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এবং কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের এপারেও মর্টার শেল-গুলি এসে পড়ছে। চলমান সংঘর্ষে হাল্কা ও ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, যার বিস্ফোরণের শব্দে কম্পিত হচ্ছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী গ্রাম তুমব্রম্ন, বাইশফারি, ফাত্রাঝিরি, রেজু আমতলি, গর্জবনিয়াসহ সীমান্ত লাগোয়া অনেক গ্রাম। ফাটল ধরেছে মাটি দিয়ে তৈরি ঘরের দেয়ালে। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না কেউ। এদিকে মঙ্গলবার রাতে অবিস্ফোরিত একটি মর্টার শেল নাইক্ষ্যংছড়ির ঘোনারপাড়া লোকালয়ে এসে পড়ে। বুধবার সকালে এসে পড়ে আরো দুটি। এতে স্থানীয়দের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর অজানা আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন সীমান্তবাসী বাংলাদেশিরা। একই সঙ্গে সীমান্ত দিয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাখাইনসহ মিয়ানমারের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এসব জায়গা পুনর্দখল করতে জান্তা সরকার মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় যাতে ফের রোহিঙ্গার ঢল বাংলাদেশের দিকে না আসে, সেটা নিশ্চিত করতে সীমান্তে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে থেমে থেমে সংঘাত চলমান। এই সংঘাতে বিভিন্ন সময় নিক্ষিপ্ত গোলা তাদের সীমানা পেরিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী লোকালয়ে এসে পড়ছে। এতে নিত্যদিনের কাজে ও শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরা। এর আগে সোমবার দুপুরে কোনারপাড়া এলাকায় বিস্ফোরিত মর্টার শেলের খোসা পাওয়া যায়। মঙ্গলবারও রাতে ঘোনারপাড়া এলাকায় মিয়ানমার থেকে নিক্ষিপ্ত অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। এসব ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে এ পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ভাজাবনিয়া সরকারি \হপ্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি নূরজাহান বেগম বলেন, 'সীমান্তের ওপারের গোলাগুলি ও গোলার শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। কোন সময় আবার গোলাগুলি শুরু হয়, তা বলা মুশকিল। এ পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে খুবই ভয় লাগে।' তুমব্রম্ন ঘোনারপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবু সিদ্দিক বলেন, 'মধ্যরাতে গোলাগুলি শুরু হলে ভয়ে কাঁচাঘরের বাসিন্দারা পাড়ার বা কাছাকাছি পাকা দালানে গিয়ে আশ্রয় নেন। মঙ্গলবার রাতে যখন আবারও গোলাগুলি শুরু হয় তখন অন্যের ঘরে আশ্রয় না পেয়ে সীমান্ত সড়কের ওপারে আশ্রয় নিয়েছিলাম।' গত শনিবার টেকনাফ সীমান্তের এপারে নুরুল ইসলামের বসতঘরে এসে পড়ে ওপার থেকে ছোড়া এলএমজির গুলি। ওইদিন বিকালে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন এক নম্বর ওয়ার্ড উলুবনিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নুরুল ইসলাম জানান, 'শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সীমান্তের মিয়ানমারের ওপার থেকে মর্টারশেল ও ভারী অস্ত্রের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ ভারী অস্ত্রের একটা গুলির শব্দ খুব কাছ থেকে শুনতে পাই। তখন দেখি, আমার বসতঘরে টিনের দরজা ছিদ্র করে একটি গুলি ঢুকে পড়ে। পরে বিজিবির সদস্যরা খবর পেয়ে তারা এসে গুলিটি নিয়ে যায়।' স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা লালু জানান, টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া, তুলাতুলি ও কানজরপাড়া সীমান্তের মিয়ানমারের ওপারে সপ্তাহজুড়ে প্রচুর গোলাগুলি চলছে। ভয়ে আমরা বাড়ি ঘরে থাকতে পারছি না এবং চিংড়ি ঘেরেও যেতে পারছি না। এখন আমাদের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে। অনেকে পরিবার দূরে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।' ঘোনারপাড়া গ্রামবাসী জানান, মঙ্গলবার ১৮টি মর্টার শেলের আওয়াজ শুনেছেন তারা। এর আগে সোমবার একটি মর্টারশেলের আঘাতে মাটি গর্ত হয়ে যায় বলে জানান তুমব্রম্ন পশ্চিমকুলের অধিবাসী আবদুর রহিম প্রকাশ বাহাদুলস্নাহ। বুধবারও সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি ও মর্টারশেলের বিকট শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। স্থানীয়রা জানান, মিয়ানমারের ওপার থেকে ছোড়া দুটি মর্টারশেল তুমব্রম্ন কোনারপাড়া এলাকায় পড়ে বিস্ফোরিত হয়। তবে এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। অন্যদিকে বুধবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ি তিন নম্বর ঘুমধুম ইউনিয়নের ভাজাবনিয়া সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন, পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন, সহকারী পুলিশ সুপার মো. আমজাদ হোসেন সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট রাজেস কুমার বিশ্বাস, নাইক্ষ্যংছড়ি নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ জাকারিয়া, উপজেলা শিক্ষা অফিসার ত্রিরতন চাকমা, ঘুমধুম তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক মাহাফুজুর রহমান প্রমুখ। এ সময় জেলা প্রশাসক বলেন, 'সীমান্তে ৩৪ বিজিবির জোয়ানরা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক খবরাখবর রাখছেন। 'বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক রয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে বিপজ্জনক এলাকায় বসবাসকারীদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হবে। এ সময় স্থানীয়দের আতঙ্কিত না হয়ে সজাগ থাকার পরামর্শ দেন তিনি।'