ইতিহাসের সর্বোচ্চ সংখ্যক ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নিয়ে প্রথম অধিবেশন শুরুর মধ্য দিয়ে যাত্রা করল বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ।
মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন গত ১৫ জানুয়ারি এই অধিবেশন আহ্বান করেন। গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া আওয়ামী লীগ এবার টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকারে।
ভোট হওয়া ২৯৯ আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জয় পায় আওয়ামী লীগ। এছাড়া গত দুই সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ১১টি, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে জাসদ একটি ও ওয়ার্কার্স পার্টি একটি এবং এক সময় বিএনপির জোটে থাকা কল্যাণ পার্টি একটি আসনে জয় পায়।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। যে ৬২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগেরই নেতা।
একজন প্রার্থীর মৃতু্যতে নওগাঁ-২ আসনের ভোট পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ভোট হবে আগামী ১২ ফেব্রম্নয়ারি। নতুন সংসদের সদস্যরা গত ১০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছ থেকে দায়িত্ব পালনের শপথ নেন। নিয়ম অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনের ফলাফল (গেজেট প্রকাশের) ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে প্রথম অধিবেশন বসার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সংসদ নেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১১ জানুয়ারি শপথ নিয়েছেন নতুন সরকারের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বড় দল বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই এ সংসদ প্রাণবন্ত হবে বলে আশা করছেন স্পিকার।
গত দু'বারের মতো এবারও সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসছে জাতীয় পার্টি। তবে গত সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের চেয়ারে বসছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
২০১৯ সালে ৩০ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। আইন অনুযায়ী এ সংসদের মেয়াদ শেষ ২৯ জানুয়ারি শেষ হয়েছে। একাদশের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরদিনই দ্বাদশ সংসদের মেয়াদ শুরু হলো।
অধিবেশনের প্রথম দিনে সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এবারও শিরীন শারমিন চৌধুরী স্পিকার এবং শামসুল হক টুকু ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন।
রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংসদের প্রথম বৈঠকে ভাষণ দেন। প্রথম অধিবেশন সংসদ থেকে সরাসরি দেখার জন্য বিদেশি কূটনীতিকসহ বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদীয় কার্যউপদেষ্টা কমিটির বৈঠক হয়। এতে অধিবেশনের কার্যকাল ও আলোচ্যসূচি ঠিক করা হবে।
নতুন সংসদের সদস্যদের আসন বিন্যাস করা হয়েছে আগেই। প্রথমবারের মতো নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সংসদের কার্যক্রম বিষয়ে দুই দিনের
'ওরিয়েন্টশন' দেওয়া হয়।
অধিবেশনকে কেন্দ্র করে সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশ এক বিজ্ঞপ্তিতে এই এলাকায় যান চলাচল সীমিত করেছে।
রাষ্ট্রপতির ভাষণ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে 'গণতন্ত্রের জয় হয়েছে' মন্তব্য করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে 'সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পথ' পরিহার করে গঠনমূলক কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
তিনি বলেছেন, 'গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমাদের আরও উন্নতি করতে হবে। ভবিষ্যতে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। ষড়যন্ত্র করে কেউ যাতে জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে, সেদিকে সবার সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, একইসঙ্গে, কেউ যাতে আন্দোলনের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে মানুষের জানমাল ও জীবিকার ক্ষতিসাধন করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সব গুজব ও অপপ্রচারের বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করে জনগণকে সম্পৃক্ত রেখে যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে হবে।'
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরুতে মঙ্গলবার সংসদে দেওয়া ভাষণে এ আহ্বান জানান রাষ্ট্রপ্রধান। প্রতিবারের মতো এবারও মন্ত্রিসভার ঠিক করে দেওয়া ভাষণের সংক্ষিপ্তসার পড়েন রাষ্ট্রপতি।
কোনো সংসদের প্রথম এবং নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। অধিবেশনের পুরোটাজুড়ে এ ভাষণের ওপর আলোচনা শেষে রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, 'দেশের গণতন্ত্রের জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষভাবে আয়োজন অত্যন্ত যুগান্তকারী ঘটনা, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় হয়েছে দেশের জনগণের, জয় হয়েছে গণতন্ত্রের।'
'দেশের সংবিধান সমুন্নত এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করায়' নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান রাষ্ট্রপতি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করায় সব ভোটার, বিশেষত নবীন ও নারী ভোটারদের অভিনন্দন জানান।
মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, 'নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সফলভাবে নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক শক্তি আরও সুদৃঢ় হয়েছে। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই, জনগণের রায় মেনে নিয়ে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।'
ভোটের আগে বিএনপির হরতাল-অবরোধের মধ্যে নাশকতার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, 'নির্বাচনকে ঘিরে একটি মহল সহিংসতা ও সংঘাত সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের শান্ত-স্নিগ্ধ যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের গণতন্ত্র বিরোধী ও সহিংস কর্মকান্ড সাময়িকভাবে জনগণকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখলেও গণতন্ত্রের শাণিত চেতনা ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
'সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সব পদক্ষেপ সার্থক হয়েছে। নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে।'
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, 'আমি আশা করি, ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পথ পরিহার করে সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণ এবং গণতন্ত্রের কল্যাণে অহিংস পন্থায় গঠনমূলক কর্মসূচি পালন করবে। সরকারও এক্ষেত্রে সংযত আচরণ করবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।'
দীর্ঘ ভাষণে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং গত দেড় দশকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির তথ্য সবিস্তারে বর্ণনা করেন রাষ্ট্রপতি।
তিনি বলেন, 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়, বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে গত দেড় দশকে আর্থসামাজিক খাতসহ সব খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। এর জন্য সমগ্র দেশবাসীর পক্ষ হতে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।'
সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ অর্জন সম্ভব হয়েছে মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি বলেন, 'উন্নয়নের মূল ভিত্তি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের অব্যাহত চর্চা। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হলে উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। গত দেড় দশকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বজায় থাকার কারণে দেশের এ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।
'উন্নয়ন স্থায়ী ও টেকসই করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজবুত, তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে। উন্নয়নের এ গতিধারা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে।'
ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা যে বাড়ছে, সে কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, 'বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে এর প্রভাব আমাদের ওপরও পড়বে। এজন্য আমাদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কৃষি খাতের উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে, উচ্চ-মূল্য ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দিয়ে রপ্তানি নিশ্চিত করার জন্য উন্নত কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।
কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাজারে যাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়, সে লক্ষ্যে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর ও কার্যকর করার ব্যবস্থা নিতে নতুন সরকারকে আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে গভীর সমুদ্রে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করারও তাগিদ দেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, 'দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজারের অনুসন্ধান করতে হবে যাতে দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানি সম্ভব হয়। আর্থিক খাতের সংস্কার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।'
প্রথমবার সংসদে ভাষণ দিতে আসা মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, 'জাতীয় সংসদ আমাদের গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূলভিত্তি। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মহান এ প্রতিষ্ঠানটি জনগণের সব প্রত্যাশার ধারক ও বাহক। তাদের চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকদের কল্যাণে জাতীয় সংসদ যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা।'
নতুন সংসদের আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'জনগণ অনেক আশা নিয়ে তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে যাতে তাদের চাওয়া-পাওয়া আপনারা সংসদে তুলে ধরেন। এটাই সংসদ-সদস্য হিসেবে আপনাদের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য।'