বিএডিসির বীজ অবিক্রীত ক্ষতি হাজার কোটি টাকা
প্রকাশ | ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
সরকারের একমাত্র বীজ উৎপাদন ও বিক্রির প্রতিষ্ঠান হচ্ছে-বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। বাজারে সবচেয়ে কমমূল্যে সরকারিভাবে ডিলারের মাধ্যমে কৃষকের কাছে উচ্চ ফলনসীল বীজ সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র কাজ। অথচ প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি কোম্পানির বীজ বিক্রির সুযোগ করে দিতে মৌসুমের শুরুতে স্বল্প মূল্যে কৃষকদের কাছে বীজ সরবরাহ বন্ধ রাখে। প্রতিষ্ঠানের একটি সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রে চলতি রবি ও বোরো মৌসুমে যথাসময়ে কৃষক পর্যায়ে বীজ সরবরাহ না করায় বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রীত রয়েছে। ফলে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা।
মাঠ পর্যায়ে বিএডিসির বীজের চাহিদা বেশি। কৃষকরা সরকারি প্রতিষ্ঠানের বীজে আস্থা রাখেন বেশি। আমন ও বোরো মৌসুমে যথাসময়ে বিএডিসির বীজ পাওয়া কৃষকের কাছে যেন সোনার হরিণ হাতের কাছে পাওয়ার মতো। অনেক সময় নেতা ধরেও কৃষকরা বীজ পান না। অথচ বিএডিসি সময়মতো বীজ সরবরাহ বন্ধ রেখে বেসরকারি কোম্পানির বীজ কিনতে কৃষকদের বাধ্য করেন। এতে বেসরকারি কোম্পানির বীজ কিনে প্রতারণার শিকার হন কৃষক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রমরমা ব্যবসা করলেও সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএডিসি লোকসান গুনছে বছর বছর।
অভিযোগ আছে, প্রায় প্রতি মৌসুমে বীজের ঘাটতি আবার কখনো বাড়তি উৎপাদন দেখিয়ে সরকারি অর্থ লুটপাট করে। বিএডিসির কিছু অসাধু কর্মকর্তা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। তারা সরকারের বীজ সময়মতো ডিলারের কাছে সরবরাহ করেন না। তখন কৃষকরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি কোম্পানির বীজ কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। কোম্পানির বীজে উৎপাদন কম হয়, আবার কখনো কখনো ফসল নষ্ট হয়। এই চক্রটি এবারও নির্বাচনের ডামাডোলে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কমিশন বাণিজ্য করে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা লাভবান হলেও সরকারের প্রায় এক হাজার ৫০ কোটি টাকা
\হলোকসান করেছেন। বিএডিসি লোকসানের কারণেই এক সময় বন্ধ হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার পূর্ণ গঠিত হয়। এরপর থেকে লোটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়। শুধু বীজ নয়, সার আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি নয়-ছয় করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) শতাধিক অভিযোগের তদন্তে নেমেছে।
দুদকের এক অভিযোগের সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো ধান, গম ও মসলা জাতীয় উচ্চ ফলনশীল বীজ অবিক্রীত থাকায় বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। উচ্চমূল্যের বাজারে আগামীতে চাল, ডাল, গম, ভুট্টাসহ কৃষি ফসল আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে।
ময়মনসিংহের ফুলপুরের বড় কৃষক আফাজ উদ্দিন বলেন, বোরোর বীজ তলা তৈরির সময় বিএডিসির ভিত্তি বীজ পায়নি, কয়েকদিন ঘরে বেসকারি কোম্পানির বীজ স্বর্ণা জাতের বীজ ধান কিনেছি।
নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বারমারি গ্রামের কৃষক সুমেন হাজং বলেন, চেয়ারম্যান ধরেও বিএডিসির বীজ পায়নি। পরে গাজীপুরের একটি কোম্পানির রনজিত নামের ধানের চাষ করছি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) বোরো ধানের ২৮ হাজার ৫ দশমিক ৩৭৯ টন বীজ অবিক্রীত রয়েছে। উচ্চ ফলনশীল ধানের এ বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রীত থাকায় প্রায় ৪ দশমিক ২ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষিবিদরা। অন্য দিকে বীজ অবিক্রীত থাকায় সরকারের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা। শুধু তাই নয় চলতি অর্থবছরে খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ারও আশঙ্কা করছেন অনেক কৃষিবিদ। এছাড়া উচ্চ ফলনশীল গম, ভুট্টা, ডালবীজ, তৈলবীজ, সবজি বীজ, মসলা ও পাটবীজও অবিক্রীত রয়েছে ৫ হাজার ৬১৩ দশমিক ১৩৪ টন।
বিএডিসির সাবেক মহাব্যবস্থাপক (বীজ) আখতারুজ্জামান বলেন, বোরো মৌসুমের শুরুতেই যদি সঠিকভাবে মনিটরিং করা হতো তাহলে বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রীত থাকত না। মূলত অক্টোবর থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বোরো বীজ রোপণ শুরু হয়। এরপর আর এই বীজ রোপণের সময় থাকে না। ফলে এই বীজ চলতি মৌসুমে কোনো কাজে আসবে না। পরবর্তীতে এই বীজগুলো চাল হিসেবে বাজারে বিক্রি করা হয়। এতে করে বীজ উৎপাদনে আর্থিক ক্ষতি হয় এবং বীজগুলো চাল হিসেবে বিক্রি করায় ফসলের উৎপাদনও কম হয়।
অভিযোগ রয়েছে, বিএডিসি ধ্বংস করতে প্রতিষ্ঠানটিতে জামায়াত-বিএনপির কিছু কর্মকর্তা কলকাঠি নাড়াচ্ছেন। সরকারের খাদ্য সংকটের ফেলার পাঁয়তারা করছে তারা। দেশে কৃষি অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি সাধন হয়। এ চক্রটি সুকৌশলে যোগ্য কর্মকর্তাদের সঠিক জায়গায় দায়িত্ব দিচ্ছে না। এতে দিন দিন প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিচ্ছে এবং সরকারকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। চাষ উপযোগী সরকারের মানসম্মত বীজ মাঠ পর্যন্ত না দিয়ে খাদ্য সংকট তৈরি চেষ্টা করছে।
কৃষিবিদ ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, বিএডিসি চুক্তিবদ্ধ চাষিদের মাধ্যমে উন্নত বীজ উৎপাদন করে। সেই উৎপাদিত বীজ প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ করে। পরবর্তী মৌসুমে কৃষক পর্ষায়ে এই বীজ সরবরাহ করার কথা। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত বীজের চেয়ে বিএডিসির বীজ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ফলন হয়ে থাকে।
বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিএডিসি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মজুত বীজের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭২ হাজার ৯৫০ টন। এর মধ্যে আউশ, আমন, বোরো ধানের বীজ ছিল ৬৬ হাজার ২৪৭ দশমিক ০৯০ টন। এর মধ্যে বোরো ধানের বীজ অবিক্রীত রয়েছে ২৮ হাজার ৫ দশমিক ৩৭৯ টন। উচ্চ ফলনশীল ধানের এ বিপুল পরিমাণ বীজ ব্যবহার না হওয়ায় চলতি মৌসুমের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।
এছাড়া উচ্চ ফলনশীল গম, ভুট্টা, ডালবীজ, তৈলবীজ, সবজি বীজ, মসলা ও পাটবীজও অবিক্রীত রয়েছে ৫ হাজার ৬১৩ দশমিক ১৩৪ টন। এর মধ্যে গম বীজ ৫ হাজার ১৯৩ দশমিক ৮৮০ টন, ভুট্টাবীজ ৩০ দশমিক ৫৭ শূন্য টন, ডাল ও তৈলবীজ ৩৩০ দশমিক শূন্য ১ হাজার ৬০ টন, সবজি বীজ ১৩ দশমিক ৯১৮ টন, মসলা ৪৪ দশমিক ৬৬০ টন। এই উচ্চ ফলনশীল বোরো বীজ বিএডিসির দেশের ২৭টি অঞ্চলে ৮ হাজার ৫৩৬ ডিলার এবং ১০০টি বীজ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে বিক্রি করার কথা। কিন্তু মৌসুমের সঠিক সময়ে বীজ সরবরাহ না করায় রবি মৌসুমের বীজ অবিক্রীত রয়েছে ৩৭ হাজার ১৩৬ দশমিক ৪০৭ টন। যার মূল্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকা।
উলেস্নখ্য, ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট বিএডিসির মহাব্যস্থাপক (বীজ) স্বাক্ষরিত ২০২৩-২৪ বিতরণ বর্ষে জন্য বোরো ধানের বীজের পুনর্নির্ধারিত বিক্রয় করা হয় দশ কেজি প্যাকেটে বিভিন্ন জাতের ভিত্তি বীজ ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজি ৫৪ টাকা, কৃষক পর্ষায়ে ৬২ টাকা। প্রত্যায়িতমান ঘোষিত বীজ ডিলার পর্ষায়ে প্রতি কেজি ৫০ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে ৫৭ টাকা। বিপুল পরিমাণ এই বীজ অবিক্রীত হওয়া এক হাজার ৫০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ ও উদ্যান) মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, শুধু চলতি বছরের বোরো মৌসুমের যে বীজ অবিক্রীত রয়েছে, এটা নতুন নয়। আমরা বেশি পরিমাণে বীজ উৎপাদন করি, তাই প্রায় বছরই বীজ অবিক্রীত থাকে।
এদিকে, চলতি বোরো মৌসুমের বীজতলা তৈরির কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে বোরো ধান রোপন চলছে। রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসলের আবাদ কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। ফলে অবিক্রীত থাকা বীজ দিয়ে আর চাষাবাদের সুযোগ নেই। ফলে অবিক্রীত বীজের আর্থিক ক্ষতিসহ উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।