নিজেকে জাপা চেয়ারম্যান ঘোষণা রওশন এরশাদের
জিএম কাদের ও চুন্নুকে অব্যাহতি, ঘোষণা আমলে নিচ্ছেন না কাদেরপন্থিরা
প্রকাশ | ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে 'অব্যাহতি' দিয়ে নিজেই দলের হাল ধরার ঘোষণা দিয়েছেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। সেই সঙ্গে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশীদকে দলের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন।
রোববার গুলশানে নিজের বাসায় দলের 'ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত' নেতাকর্মীকে নিয়ে মতবিনিময় সভা করে এই ঘোষণা দেন জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের স্ত্রী। এ সময় তিনি বলেন, 'দলের গঠনতন্ত্রের ২০-এর ১ ধারা অনুযায়ী জিএম কাদের ও চুন্নুকে অব্যাহতি প্রদান করলাম।'
তবে 'অব্যাহতির' ঘোষণার পর জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, 'এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিই না। কারণ এগুলো একাধিকবার হয়েছে। তবে তারা এসব করে জাতীয় পার্টিতে কোনো ভাঙন ধরাতে পারেনি। তারা যা করেছেন সেটি তাদের এখতিয়ার-বহির্ভূত।'
দলের পরবর্তী কাউন্সিলের আগ পর্যন্ত তার ঘোষিত মহাসচিব কাজী মামনুর রশীদ দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন বলে মতবিনিময় সভায় জানান রওশন এরশাদ।
রওশন এরশাদ আরও বলেন, 'জাতীয় পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা মেনে নিতে পারি না। জাপা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। জিএম কাদের এবং মুজিবুল হক চুন্নু দলকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন।'
রওশন এরশাদ তার বাসভবনের নিচে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। এতে জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত, অব্যাহতিপ্রাপ্ত, স্বেচ্ছায়
পদত্যাগকারী নেতাকর্মী অংশ নেন।
এ মতবিনিময় সভায় ছিলেন জাতীয় পার্টি থেকে অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়, শফিকুল ইসলাম, জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত এবং রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদ। আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য দেলোয়ার হোসেন খান, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম সারওয়ার মিলন, জিয়াউল হক মৃধা, ভাইস চেয়ারম্যান আমানত হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, নুরুল হক, খোরশেদ আলম, ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি ইয়াহিয়া চৌধুরী, জাতীয় ছাত্র সমাজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রফিকুল হক, এরশাদপুত্র ও দলের যুগ্ম মহাসচিব সাদ এরশাদ।
সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে জাপা থেকে অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম রওশন এরশাদের উদ্দেশে বলেন, 'দলের মধ্যে আবর্জনা পরিষ্কার আপনার নেতৃত্বে করতে চাই। আপনি জাপার হাল ধরবেন। জিএম কাদের ও চুন্নুকে নেতাকর্মী নেতৃত্বে দেখতে চায় না। আজকে থেকে আপনাকে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চাই।'
ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া চৌধুরী বলেন, 'বাড়ির দারোয়ানরা এখন মালিক হতে চায়। আপনার নেতৃত্বে দল করেছি। এ সংকটে আপনাকে আবার এগিয়ে আসতে হবে।'
প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় বলেন, দলের মধ্যে বর্গির হানা পড়েছে। আবার আপনাকে দায়িত্ব নিয়ে দল রক্ষা করতে হবে।
রওশনের কাছ থেকে মহাসচিবের দায়িত্ব পাওয়া কাজী মামুনুর রশিদ মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, 'পরবর্তী কাউন্সিল হওয়া পর্যন্ত আমি মহাসচিব হিসেবে থাকব। আমি চেষ্টা করব সংগঠনের গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে। ফেব্রম্নয়ারিতে অথবা মার্চের প্রথম সপ্তাহে কাউন্সিল হবে।'
প্রসঙ্গত, জিএম কাদের জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোটভাই। এরশাদপত্নী রওশন এরশাদের সঙ্গে জিএম কাদেরের রাজনৈতিক টানাপড়েন সব সময়ই লেগে ছিল। এর আগেও নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন রওশন এরশাদ। তবে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে রওশন এরশাদের সঙ্গে জিএম কাদেরের দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। রওশন এরশাদ এবং তার ছেলে রাহগির আলমাহি এরশাদ নির্বাচনে অংশই নেননি। আর ওই নির্বাচনের পর দলের একাংশ জিএম কাদেরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা) থেকে বাদ পড়া নেতাদের এক জোট হওয়ার চেষ্টার খবর পাওয়া যাচ্ছিল কদিন ধরে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, হয় তারা সংগঠিত হয়ে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জ্যেষ্ঠ নেতা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পৃথক অবস্থান নেবেন। না হয় 'তৃণমূল জাতীয় পার্টি' নামে দল গঠন করে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করবেন।
এরই অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার জাপার কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের বেশকিছু নেতাকর্মী জোটবদ্ধ হয়ে দল থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তাদের সংখ্যা ৬৬৮ বলে জানিয়েছিলেন, 'গণপদত্যাগ' কর্মসূচির আয়োজক শফিকুল ইসলাম। তাকে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটির আহ্বায়কের পদ থেকে সদ্য অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তারা জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হকের (চুন্নু) বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে তাদের নেতৃত্বে দল না করার কথা জানান।
ঘোষণা আমলে নিচ্ছি না:চুন্নু
এদিকে রোববার ঢাকার গুলশানের বাসায় জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, জিএম কাদেরকে বহিষ্কার করে রওশন এরশাদ। যিনি নিজেই নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন তাকে আমলে নিচ্ছে না জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলের গঠনতন্ত্রে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে এমন কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তাই রওশনের ঘোষণার কোনো ভিত্তি নেই।
মুজিবুল হক বলেন, প্রত্যেকটি দলের গঠনতন্ত্র আছে। জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছে। প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছেন জিএম কাদের। কাজেই নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী তিনি দলের চেয়ারম্যান। মুজিবুল হক মহাসচিব।
মুজিবুল হক বলেন, গঠনতন্ত্রে এমন কোনো ধারা নেই যে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক কাউকে বাদ দেবেন। রওশন এর আগে জিএম কাদেরকে বহিষ্কার ঘোষণা করেছেন। এটা তৃতীয়বার। পরে ঘোষণা আবার প্রত্যাহারও করেছেন।
মুজিবুল হক বলেন, 'আমরা এটা নলেজে (আমলে) নিচ্ছি না। এর ভিত্তি নেই। গঠনতন্ত্রে তার (রওশন) এ ধরনের কোনো ক্ষমতা নেই।'
এর আগে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটলেও তাতে তৃণমূলের সমর্থন ছিল না। এবার আর আপনারা টিকতে পারবেন না- রওশনপন্থিদের এই বক্তব্যের বিষয়ে মুজিবুল হক বলেন, 'অবান্তর কথা। এইগুলি একদম অশিক্ষিত মানুষের মতো....। গঠনতন্ত্রের বাইরে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো কথা বলতে পারেন। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই।'