বিশ্বের মধ্যে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা নিয়মিতই ওপরের দিকে থাকছে। বিশেষ করে শীতের সময়ে ঢাকার বাতাসের বিষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। এ সময়ে হাসপাতালে রোগী বেড়ে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণকেও দায়ী করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছরের নভেম্বর থেকে প্রায়ই দূষিত বায়ুর শহরের শীর্ষে উঠে আসছে ঢাকার নাম। চলতি মাসের পুরো সময় জুড়েই ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর ছিল। এর মধ্যে ২১ দিন ঢাকার বাতাসের মান ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। আর দূষণের তালিকায় অবস্থান ছিল দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ স্থানে। বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত টানা তিন দিন দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে ছিল ঢাকার নাম। এর মধ্যে শুক্রবার ঢাকার দূষণ বিপজ্জনক মাত্রায় চলে যায়, এদিন বায়ুমান ছিল ৩১৭।
বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বায়ুদূষণের ফলে দেশে প্রতি বছর ৮০ হাজার মানুষ মারা যান। এছাড়া দূষণের কারণে মানুষের বিষণ্ন্নতা বাড়ছে, যার অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির চার ভাগেরও বেশি বায়ুদূষণের কারণে গর্ভবতী মা-শিশুরা ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্টের নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কমিটি এবং তহবিল পাওয়ার পরও দেশের বাতাসের গুণগত মান উন্নত না হওয়া অত্যন্ত পরিতাপের। বায়ুদূষণের একাধিক উৎস থাকায় ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অংশে বায়ুদূষণ মোকাবিলায় বায়ুর গুণমান ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন ছাড়া বায়ুদূষণ থেকে পরিত্রাণের অন্য কোনো পথ খোলা নেই বলে মনে করেন তারা।
ভৌগোলিক কারণে প্রতি বছর শীত মৌসুমে ঢাকায় বায়ুদূষণ বাড়লেও এবার শীত শুরুর বেশ আগে থেকেই রাজধানীর বাতাসে দূষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ফলে দূষণের দিক থেকে প্রায়ই প্রথম হচ্ছে ঢাকা। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স'র (একিউআই) সূচকে গত প্রায় তিন মাসে ঢাকা
একাধিকবার ৩০০'র বেশি একিউআই স্কোর নিয়ে নাম লিখিয়েছে সর্বোচ্চ দূষিতের তালিকায়।
একিউআই'র তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উৎস। ঢাকার বাতাসে যতটা এই বস্তুকণা আছে, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) মানদন্ডের চেয়ে ৩৮ থেকে ৫০ গুণ বেশি। সংস্থাটির মানদন্ড অনুযায়ী, স্কোর ৫১-১০০ হলে তাকে 'মাঝারি' বা 'গ্রহণযোগ্য' মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১-১৫০ স্কোরকে 'সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর' ধরা হয়। স্কোর ১৫১-২০০ হলে তা 'অস্বাস্থ্যকর' বায়ু। স্কোর ২০১-৩০০ হলে তাকে 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' বায়ু ধরা হয়। ৩০১ থেকে তার ওপরের স্কোরকে 'দুর্যোগপূর্ণ' বা 'ঝুঁকিপূর্ণ' ধরা হয়।
বারবার দূষণের তালিকায় ঢাকার শীর্ষে চলে আসার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণকে চিহ্নিত করেছেন পরিবেশবাদীরা। তাদের মতে, বড় বড় প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলায় বায়ুদূষণ বাড়ছে। যেকোনো ধরনের নির্মাণ কাজের সময় বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেসব নিয়ম পালনের তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ শীতকালে ভারতের অংশ থেকে বাংলাদেশের দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়। ফলে দিলিস্নর বায়ুদূষণ চরম আকার ধারণ করলে কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশেও বায়ুদূষণের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। আবহাওয়াবিদরা এই দূষণকে বলেন 'রিজিওনাল এয়ার পলিউশন'।
বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্ট ২০২০ সালে নয় দফা নির্দেশনা দেন। কিন্তু এগুলো পরিপালনে বাস্তবসম্মত কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। তারা বলছেন, এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা গেলে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক কমে আসত।
রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য বিশেষজ্ঞরা সিটি করপোরেশনকে দুষছেন। কারণ সড়কে নিয়মিত পানি ছিটায় না সিটি করপোরেশন। তবে এর সম্পূর্ণভাবে দ্বিমত পোষণ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দু'টো স্প্রে ক্যানন এবং দশটি গাড়ির মাধ্যমে মহাসড়কে নিয়মিত পানি ছিটাচ্ছে ডিএনসিসি।
বায়ুদূষণের অন্যতম একটি উৎস ইটভাটা। দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ক্যাপস'র 'দেশব্যাপী ৬৪ জেলার বায়ুদূষণ সমীক্ষা ২০২১' অনুযায়ী, ঢাকার আশপাশের প্রায় ১২শ' ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্পকারখানা আছে, যেগুলো দূষণের অন্যতম কারণ। ইট ভাটাগুলো শুষ্ক মৌসুমে চলমান থাকে। শীতকালে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কম থাকার ফলে এই সময়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ঘটে বায়ুদূষণ। অথচ বায়ুদূষণ হ্রাসের লক্ষ্যে 'ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)' শীর্ষক আইন গৃহীত হলেও আইনের তেমন প্রয়োগ নেই।
অবকাঠামো নির্মাণ বা মেরামতের সময় ধুলাবালি যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে না যায়, সেজন্য নির্মাণ স্থানে যথাযথ অস্থায়ী ছাউনি বা বেষ্টনী দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। সেইসঙ্গে, বেষ্টনীর ভেতর ও বাইরে নির্মাণ সামগ্রী (মাটি, বালু, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি) যথাযথভাবে ঢেকে রাখা এবং দিনে কমপক্ষে দুইবার স্প্রে করে পানি ছিটানোর কথা বলা আছে পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনায়। এছাড়া নির্মাণাধীন রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করা, দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করা এবং নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে পরিবহণ করার কথাও বলে অধিদপ্তর। তবে এসব নিয়ম কাগজে-কলমে থাকার মাঝেই সীমাবদ্ধ বলে অভিযোগ তাদের।
বায়ুদূষণের আরেকটি উৎস ফিটনেসবিহীন গাড়ি। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বাস চলে, তার সত্তর শতাংশেরই আয়ুষ্কাল শেষ। ফলে এর মাধ্যমেও ঘটছে বায়ুদূষণ। কারণ কোনো যানবাহনের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেলে সেগুলো ঠিকভাবে জ্বালানি পোড়াতে পারে না এবং তখন সেগুলোর ধোঁয়ার সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত হয়। ক্যাপস'র গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার যেসব এলাকায় বর্জ্য পোড়ানো হয়, সেসব এলাকাতে বায়ুদূষণ বেশি ঘটে। ময়লার স্তূপ যেখানে থাকে, সেখানে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। অনেক সময় এই মিথেন গ্যাসের দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য পরিচ্ছন্ন কর্মীরা আগুন জ্বালায়। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার অন্তত ৫০টি স্থানে পোড়ানো বর্জ্য থেকেও বায়ুদূষণ ঘটছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও ঢাকার বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে এসব উৎসকে দায়ী করা হয়েছে। তবে ঢাকার বায়ুর মান উন্নয়নে বিভিন্ন সময় সিটি করপোরেশনকে পানি ছিটিয়ে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান এবং রাস্তার ওপর নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখার জন্য অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, এরপরও পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেনি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন ক্লিন এয়ার ফান্ড (সিএএফ) পরিচালিত 'দ্য স্টেট অব গেস্নাবাল এয়ার কোয়ালিটি ফান্ডিং ২০২৩' শিরোনামের গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বায়ুদূষণ রোধে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে ২.৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। এরপরও ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে তা কোনো ভূমিকা রাখেনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন আন্দোলন বলছে, বছরে ১০ শতাংশ হারে ঢাকায় বাড়ছে বায়ুদূষণ। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এর ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ, পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং শ্বাসযন্ত্রে তীব্র সংক্রমণের ফলে দেশে মৃতু্যহার বাড়ছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের পর ২০২৩ সালে ঢাকার বায়ুমান সবচেয়ে খারাপ ছিল। আর বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি বছরও বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে কিনা- এমন আশঙ্কা রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার একটি সংবাদমাধ্যমকে জানান, গত ১০ বছরের মধ্যে গড়ে এ বছর ১০ ভাগেরও বেশি বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা একটা বড় শঙ্কার বিষয়।