শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা

এক বছরে ৫১৩ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বেশি স্কুলগামী

তাদের মধ্যে ৬০.২ % নারী হ সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে
যাযাদি ডেস্ক
  ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
এক বছরে ৫১৩ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বেশি স্কুলগামী

গত বছর দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৬০ দশমিক ২ শতাংশ রয়েছেন নারী। শিক্ষার স্তর বিবেচনায় এই 'মিছিলে' ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ রয়েছে স্কুলগামী শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৪৯ জন আত্মহত্যা করেন। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী বলি হয়েছেন 'অভিমানের ছুরিতে'।

সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ২০২৩ সালের আত্মহত্যার চিত্র তুলে ধরেন সংগঠনটির রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার লাবনী। আত্মহত্যা কমাতে বেশকিছু সুপারিশও তুলে ধরেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের মতে, এসব ঘটনা রোধে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। পাশাপাশি নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে শিক্ষার্থীদের মানসিক বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শেখাতে হবে। এজন্য সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে।

ফারজানা আক্তার লাবনী বলেন, গত বছর আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলে ২০৪ জন, নারী ৩০৯ জন। ২০২২ সালে আত্মহত্যা করেন ৫৩২ জন। এ বছর কিঞ্চিৎ কমলেও তা আশানুরূপ নয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২৩ সালে ২২৭ জন স্কুল শিক্ষার্থী (৪৪.২০%) আত্মহত্যা করেন। কলেজ শিক্ষার্থী রয়েছেন

১৪০ জন (২৭.২%), বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৯৮ জন (১৯.১%) এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ৪৮ জন (৯.৪%)। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৪৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৯ জন, রাজশাহী বিভাগে ৭৭ জন, খুলনা বিভাগে ৬৪ জন, বরিশাল ও রংপুর বিভাগে ৪৩ জন করে, ময়মনসিংহে ৩৬ জন ও সিলেটে ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।

এগিয়ে নারীরা : ২০২৩ সালে আত্মহনন করা মোট শিক্ষার্থীর ৬০.২% মেয়ে। তাদের আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৮.৮% আত্মহত্যা করেন অভিমানে, ১৬.৫% প্রেমঘটিত কারণে, ৮.৪% মানসিক ভারসাম্যহীনতায়, ৭.১% পারিবারিক কলহে, ৩.৯% যৌন হয়রানি, ৪.২% পড়ালেখার চাপে ও অকৃতকার্য হয়ে, ১.৬% পারিবারিক নির্যাতনে, ০.৬% অপমানে এবং ২.৯% কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে আত্মহত্যা করেন।

বত্রিশ শতাংশের বেশি বলি 'অভিমানে': আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে বড় কারণ অভিমান। মোট শিক্ষার্থীর ১৬৫ জন (৩২.২%) অভিমান করে, ১৪.৮% প্রেমঘটিত কারণে, ৯.৯% মানসিক সমস্যাজনিত কারণে, ৬.২% পারিবারিক কলহে, ১.৪% পারিবারিক নির্যাতনে, ৪.৫% পড়ালেখার চাপে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ৩.৫%, ১.৮% কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে, ২.৫% যৌন হয়রানি ও ০.৮% অপমান বোধ করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

বেশি আত্মহত্যা স্কুল পর্যায়ে : মোট শিক্ষার্থীর ৪৪.২% স্কুলগামী গত বছর আত্মহত্যা করেন। কলেজ শিক্ষার্থী রয়েছেন ১৪০ জন (২৭.৩%), বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ১৮ জন (১৯.১%) ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ৪৮ জন (৯.৫%)।

ঝুঁকিপূর্ণ বয়ঃসন্ধিকাল : আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, বয়ঃসন্ধিকালে নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এ সময়টাতে বেশি রাগ-অভিমানের প্রবণতাও থাকে। গেল বছরের চিত্রে দেখা যায়, ১৩-১৯ বছর বয়সি ৩৪১ শিক্ষার্থী (৬৬.৫%) আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ২২২ জনই মেয়ে; বিপরীতে ছেলে ১১৯ জন।

২০-২৫ বছর বয়সিদের আত্মহত্যার হার ২৩.৪%, ২৬-৩০ বছর বয়সি ২.৩%, আর এক-দুই বছর বয়সি শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার হার ৭.৮%।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর বয়সে হরমোনজনিত কারণে শিক্ষার্থীরা বেশি আবেগপ্রবণ থাকে। ফলে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি থাকে।

সুপারিশ : আত্মহত্যা কমাতে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি মাসে অন্তত একবার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার তাগিদ দেওয়া হয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে মেন্টর নির্ধারণ এবং উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেন্টাল হেলথ কর্নার চালু করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রচার চালু করতে হবে। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতা শেখাতে হবে।

এছাড়া যে কোনো নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে শিক্ষার্থীদের কৌশল, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শেখাতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিবারের সদস্যদের আত্মহত্যার আলামত সম্পর্কে ধারণা বিস্তৃত করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ইন্সু্যরেন্স বীমার আওতায় আনা, যেন তা সবার জন্য সাশ্রয়ী হয়। মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দ্রম্নত ও সহজলভ্য করতে টোল ফ্রি জাতীয় হট লাইন নম্বর চালু করতে হবে।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. সাইদুর রহমান, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিব এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে