দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের আজ গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনের বৈঠক থেকে সংসদে ভূমিকার প্রশ্নে এবং সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টনের বিষয়ে দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। এদিকে, সংসদে নিজেদের ভূমিকা কী হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা।
গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২৩ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। ১০ জানুয়ারি সংসদ সদস্যরা শপথ নেন। সেদিন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংসদ নেতা নির্বাচিত করে। পরদিন শপথ নেয় নতুন মন্ত্রিসভা।
তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল কারা হবে, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা বিরোধী দলের আসনে বসবেন কিনা। স্বতন্ত্রদের ভূমিকা আসলে কী হবে-এসব বিষয়ে নানা আলোচনা রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের অনেকে বলছেন, তাদের বেশির ভাগই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সংসদে ভূমিকা রাখতে চান। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ বলছেন, দলে যুক্ত না হয়ে তারা স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবেই ভূমিকা রাখবেন, দলে এই আলোচনা রয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, এটি আগেই পরিষ্কার ছিল। প্রশ্ন ছিল প্রধান বিরোধী দল কারা হবে, তা নিয়ে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পর এবার সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে একাদশ সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলটি ১১টি আসন পেয়েছে। কিন্তু তাদের চেয়ে অনেক বেশি, ৬২টি আসনে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাদের ৫৮ জন আবার আওয়ামী লীগেরই নেতা।
এমন পটভূমিতে কারা প্রধান বিরোধী দল হবে, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন-এসব প্রশ্ন
সামনে আসে। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা মিলে নির্দলীয় জোট করে প্রধান বিরোধী দল এবং তাদের একজনকে বিরোধীদলীয় নেতার মর্যাদা দেওয়ার জন্য জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে আবেদন জানানোর সুযোগ আছে। তবে একাধিক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বড় অংশই বিরোধী দলে বসার বিপক্ষে। তারা চান, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে। কারণ, হিসেবে তারা বলছেন, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হলেও তারা আওয়ামী লীগের নেতা। তবে এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে নেবে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন।
অন্যদিকে কেউ কেউ স্বতন্ত্রদের একটি মোর্চা করে বিরোধী দলে বসার পক্ষেও আছেন। তাদের পাওয়া আসনের বিপরীতে সংরক্ষিত নারী আসন কীভাবে বণ্টন হবে, সে বিষয়েও এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা এখন পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনাও করেননি।
এমন পরিস্থিতিতে আজ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে নিজেদের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চান না স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। তারা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে নিজেরা বসে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে দলীয় প্রধানের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বাস্তবতা নেই বলেও মনে করেন কেউ কেউ। বৈঠকে দলীয় প্রধান জানতে চাইলে স্বতন্ত্ররা নিজ নিজ অবস্থান থেকে বক্তব্য তুলে ধরবেন। তবে তারা মূলত অপেক্ষা করছেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনার জন্য। রোববার সে নির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে। প্রয়োজন হলে এরপর তারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করবেন।
দ্বাদশ সংসদে স্বতন্ত্র কতজন? এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে আগামী মঙ্গলবার; এর আগে প্রধান হুইপ ও পাঁচ হুইপ নিয়োগ দেওয়া হলেও বিরোধীদলীয় নেতা এখনো অনুমোদন হয়নি। এবারের ভোটে যে রেকর্ড ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তারা জোট বা কোনো দলে যোগ দিচ্ছেন কিনা, তাও স্পষ্ট হয়নি।
তবে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টনে দলে বা জোটভুক্ত হওয়ার বিষয়টি তাদের আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২৩টি, জাতীয় পার্টি ১১টি, জাসদ একটি, ওয়ার্কার্স পার্টি একটি, কল্যাণ পার্টি একটি এবং স্বতন্ত্ররা ৬২টি আসন পেয়েছে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত নারী আসন আওয়ামী লীগ পাবে ৩৮টি, জাতীয় পার্টি পাবে দুটি, আর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা পাবেন ১০টি আসন।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, 'দ্বাদশ সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী পাঁচটি দল ও ৬২ জন সংসদ সদস্যকে দল ও জোটভুক্ত হওয়ার বিষয়ে মতামত জানাতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে তা কমিশনকে জানাতে হবে। এরপরই সংরক্ষিত নারী আসনের ভোটের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা রাজনৈতিক দলে বা জোটে যোগদান করতে চাইলে তা ৩১ জানুয়ারির মধ্যে জানাতে মঙ্গলবার দলগুলোর কাছে চিঠি পাঠায় ইসি।
সেখানে বলা হয়, 'কোনো নির্দলীয় সংসদ সদস্য আপনার দলে বা জোটে যোগদান করেছেন কিনা, অথবা সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে অন্য কোনো দলের সঙ্গে আপনার দলে জোট গঠিত হয়েছে কিনা; তা ৩১ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করতে হবে।' ইতোমধ্যে জোটওয়ারি তালিকাভুক্ত করতে জাসদ চিঠি দিয়েছে ইসিতে।
অতিরিক্ত সচিব অশোক জানান, বৃহস্পতিবার জাসদের নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্যকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত করার জন্য জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু চিঠি দেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্বতন্ত্ররা দল বা জোটভুক্ত না হলে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান তিনি।
স্বতন্ত্ররা যা বলছেন : এবার রেকর্ড ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৫৯ জনই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। বাকিদের মধ্যে দুইজন সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তাদের একজন মোহাম্মদ সিদ্দিকুল আলম জাতীয় পার্টির মনোনয়ন না পেয়ে নীলফামারী-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বাজিমাত করেছেন। নৌকার ছাড় পেয়েও আসনটিতে জিততে পারেননি জাতীয় পার্টির প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান।
জানতে চাইলে সিদ্দিকুল আলম বলেন, 'আমি জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছি, এখনো স্বতন্ত্র আছি। নির্বাচিত হওয়ার পর দল আমাকে ডাকেনি, আমিও যোগাযোগ করিনি। প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ দিয়েছেন, সেখানে তিনি যে নির্দেশনা দেবেন, সেটাই আমরা স্বতন্ত্ররা মেনে নেব।' স্বতন্ত্রদের জোট করার বিষয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি বলে ভাষ্য এই সংসদ সদস্যের।
সিদ্দিকুল বলেন, 'বিষয়টি ইসিকেও জানাতে হবে। সময়ও রয়েছে। (প্রধানমন্ত্রীর) দিকনির্দেশনার পর আলোচনায় বসে একটা সিদ্ধান্ত হবে আশা করি।'
সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট) আসনে নৌকাকে হারিয়ে জয় পান ধর্মভিত্তিক সংগঠন আঞ্জুমানে আল ইসলাহ'র সভাপতি মোহাম্মদ হুছাম উদ্দিন চৌধুরী। সরকার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ফুলতলীর এই পীরের কাছে ১৪ হাজার ভোটে হারেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাসুক উদ্দিন আহমদ। হুছামুদ্দীন চৌধুরীর ইচ্ছা, কোনো জোট বা দলে যোগ না দিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে ভূমিকা রাখার।
তিনি আরও বলেন, 'রোববার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে আমাদের। আমিও গণভবনে আমন্ত্রণে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। তিনি কী দিকনির্দেশনা দেন, দেখি। আমি তো কোনো দলের হয়ে নির্বাচন করিনি, তাই স্বতন্ত্র। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা অতীতে যেভাবে ভূমিকা রেখেছে, আমিও তাই রাখতে চাই।'
দিনাজপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মো. জাকারিয়া বলেন, 'আমি বীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এখন সংসদ সদস্য। আমার তো অন্য দলে বা স্বতন্ত্র থাকার সুযোগ নেই। আমি আওয়ামী লীগের। এখন আপার (প্রধানমন্ত্রী) সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি, তিনি যে দিকনির্দেশনা দেবেন, সেভাবেই আমরা কাজ করব।'
অপেক্ষা জাতীয় পার্টিরও : দ্বাদশ সংসদে প্রধান বিরোধী দল কারা হবে, সেই প্রশ্নের মধ্যেই ১১টি আসন পাওয়া জাতীয় পার্টি গত ১৮ জানুয়ারি তাদের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে মনোনীত করে।
সেদিন দলের সংসদীয় সভায় কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে বিরোধী দলের উপনেতা ও মহাসচিব মজিবুল চুন্নুকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মনোনীত করা হয়। এসব মনোনয়নের সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে জানিয়েছে জাতীয় পার্টি।
নিয়ম অনুযায়ী, জাতীয় পর্টির সংসদীয় দলের এই মনোনয়নের চিঠি পাওয়ার পর স্পিকার এতে সম্মতি দিলে তবেই বিষয়টি কার্যকর হবে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, 'দ্বাদশ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা অনুমোদনের এখতিয়ার স্পিকারের। এখনো আমরা স্পিকারের সিদ্বান্ত জানি না। আশা করি, অধিবেশনের আগেই সিদ্ধান্ত আসবে।' জাতীয় পার্টিতে কোনো স্বতন্ত্র সদস্য কেউ যুক্ত হচ্ছে কিনা, তা স্পষ্ট করেননি তিনি।
দল থেকে বহিষ্কৃত নীলফামারী-৪ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যকে দলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে কিনা বা এ ধরনের ভাবনা আছে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে চুন্নু বলেন, 'বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে জিতে এসেছে। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সিদ্দিকুল আলম যোগাযোগ করেনি, এখনো এ বিষয়ে দল থেকেও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।'