কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো মাদক ও অস্ত্রের স্বর্গরাজ্য। মিয়ানমারের নিষিদ্ধ সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), ইসলামী মাহাজ, জমিয়তুল মুজাহিদীন ও আল ইয়াকিনসহ অন্তত ৩০ সশস্ত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ক্যাম্পে নিবন্ধিত হয়ে বসবাস করছেন। এসব সংগঠনের রয়েছে অন্তত ৫০ হাজার সন্ত্রাসী। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব সন্ত্রাসীরা ক্যাম্প এবং ক্যাম্প সংলগ্ন গহিন অরণ্যে গড়ে তুলেছে অবৈধ অস্ত্রের মজুত। গত প্রায় সাড়ে ৬ বছরে ক্যাম্পে নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের সংঘর্ষে খুন হয়েছেন দুই শতাধিক। এসব ঘটনায় গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৯ শতাধিক দেশি-বিদেশি অস্ত্রসহ দুই হাজারের বেশি সন্ত্রাসী ও মাদক চোরাকারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক। সবশেষ বৃহস্পতিবার ভোরে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন লালপাহাড়ের্ যাব-১৫-এর অভিযানে ২২টি দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গুলি ও রোমা তৈরির সরঞ্জামসহ আরসার তিন সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর আগে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৫ কেজি বিস্ফোরক, ১৫টি ককটেল ও আইডি তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করের্ যাব-১৫ সদস্যরা। এ সময় গ্রেপ্তার হন আরসার কমান্ডারসহ তিন সদস্য।
ভুক্তভোগীরা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুধু রাতে নয়, দিনেও চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা শুরু হলে
এরা শূন্য রেখার কাছে গহিন অরণ্যে আত্মগোপনে চলে যায়। অভিযান শেষে আবারো ক্যাম্পে ফিরে আসে। উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পেই পরস্পরবিরোধী একাধিক রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রম্নপ এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই ক্যাম্পগুলোর সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খুনোখুনি, অপহরণ, গুম, লুটপাট, মাদক সেখানে এখন স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। আরসা ও আরএসও'র সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আরসার সদস্যরা বাস্তুচু্যত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আন্দোলন করছে। এক্ষেত্রে আরএসও'র বেশিরভাগ নেতা প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করছে। এই নিয়ে আরসা ও আরএসও'র মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে। আর এ কারণে ক্যাম্পে দুই গ্রম্নপের মধ্যে খুনোখুনি ও হামলার ঘটনা বেড়ে চলেছে।
এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য না দিলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, মানবপাচারসহ গুরুতর অপরাধের সঙ্গে এই দুই সন্ত্রাসী গ্রম্নপের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আরসার সদস্যরা অস্ত্র ও মাদক চোরাকারবারে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তারা ক্যাম্পের সদস্যের তালিকায় নাম লেখালেও বেশির ভাগ সময় শূন্য রেখায় অবস্থান করে। আবার কিছু সদস্য সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে।
২০২৩ সালের ২১ জুলাই আরসার রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার সামরিক কমান্ডার হাফেজ নূর মোহাম্মদসহ ৬ জনকে আটক করের্ যাব। তখনর্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'আরসার শীর্ষ কমান্ডার হাফিজ নূর ৩০-৩৫ সদস্যের একটি অপরাধী চক্রের নেতৃত্ব দেন। তারা কুতুপালং ক্যাম্প ও এর আশপাশের এলাকায় নিয়মিত হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ করে আসছে। তারা প্রতিবেশী দেশ থেকে দুর্গম সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র পাচার করে এবং সেই অস্ত্র দিয়ে অপরাধ করতো এবং স্থানীয় অপরাধী গোষ্ঠীকেও অস্ত্র সরবরাহ করতো।'
খন্দকার আল মঈনের ভাষ্যে- 'স্থানীয়দের ভয় দেখিয়ে হত্যা ও অপহরণের হুমকি দিয়ে তারা চাঁদাবাজি করতো। দাবি পূরণ না হলে তারা স্থানীয়দের অপহরণ করে এমনকি তাদের হত্যা করে গভীর পাহাড়ি এলাকায় লাশ লুকিয়ে রাখতো। মাদক চোরাকারবারিদের কাছ থেকে তারা টোলও আদায় করে এবং অপরাধ করার পর তারা গভীর বন ও পাহাড়ে আত্মগোপন করে।'
২০২২ সালের নভেম্বরে বান্দরবানের তমব্রম্ন সীমান্তে চোরাকারবারিদের হাতে ডিজিএফআই'র এক কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদক চোরাকারবারি ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থানে যায়। এ সময় আরসা ও আরএসও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অন্তত ৭শ' জনের নাম তালিকাভুক্ত করে অভিযানে নামে যৌথ বাহিনী। যদিও এর আগে থেকেই প্রশাসন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ১৪ এপিবিএন'র (পুলিশ) তথ্য অনুযায়ী, ছয় বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চালানো অভিযানে ৪০০ আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৫০০ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এ ঘটনায় ৩৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই সময়ে ৩৯ লাখের বেশি ইয়াবা ও ৪০ কেজি আইসসহ এক হাজার ৬৯৭ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া ৩৬৪ রোহিঙ্গা অপহরণের ঘটনায় ৭৪টি মামলায় ৯৮ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তত দেড় শতাধিক হত্যাকান্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস, ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর নামের এক নেতা (মাঝি), ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ নামে এক জন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ওই বছরের ২২ অক্টোবর ক্যাম্প-১৮-এর একটি মাদ্রাসায় ছয় জনকে হত্যা করা হয়। এর আগে একই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা নেতা মহিবুলস্নাহকে। ২০২২ সালের ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা ও ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ওই বছরের ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক জন নেতা মারা যান। ২০২৩ সালের মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানাউলস্নাহ ও সোনা আলী। একই বছরের ৭ জুলাই আরএসও'র হাতে খুন হন আরসার পাঁচ সদস্য। ৫ ডিসেম্বর উখিয়া শিবিরে আরসা ও আরএসও'র মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় নিহত হন ৪ জন। এ নিয়ে ১৫ দিনের ব্যবধানে সাবেক হেড মাঝিসহ ৯ জন হত্যাকান্ডের শিকার হন।
উখিয়ার লালপাহাড়ে আরসার
আস্তানায় অভিযান, অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ৩
টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২০ এক্সটেনশন সংলগ্ন লালপাহাড়ে আরসা'র আস্তানায় অভিযান চালিয়েছের্ যাব। অভিযানে ২২টি অস্ত্র, ৬০টি গুলি, ৪টি মাইন বোমা, ৬টি মোবাইল, ৬টি শটগানের কার্তুজ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ ৩ আরসা সদস্যকে আটক করা হয়। আটকরা হলেন- কমান্ডার উসমান, ইমান হোসেন এবং নেচার। তারা সবাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজারর্ যাব-১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এ সময় কক্সবাজারর্ যাব-১৫ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ল' এন্ড মিডিয়া) মো. আবু সালাম চৌধুরীসহর্ যাব কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
র্
যাবের এই কর্মকর্তা জানান, আরসা সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে লালপাহাড়ের গহিনে নাশকতার লক্ষ্যে অবস্থান করছে, এমন সংবাদের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে এক কমান্ডারসহ ৩ সদস্যকে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, আটকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।