মাঘের প্রথম সপ্তাহ থেকেই তীব্র শীতে কাঁপছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পারদও নিম্নমুখী। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ২৯ বছর আগে ঢাকায় রেকর্ড হওয়া সর্বনিম্ন তাপমাত্রার প্রায় কাছাকাছি নেমে এসেছে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। একদিনের ব্যবধানে প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে মঙ্গলবার ৬.৬ ডিগ্রি রেকর্ড হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গায়। চলতি শীত মৌসুমে এখন পর্যন্ত এটিই দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এদিকে মঙ্গলবার সকালে রোদ ঝলমলে ঢাকার তাপমাত্রা আগের দিনের চেয়ে এক ডিগ্রির বেশি কমেছে। এদিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আগের দিন যা ছিল ১২.৩। কুয়াশাও ছিল দুপুর পর্যন্ত। এরইমধ্যে আজ বুধ ও কাল বৃহস্পতিবার বৃষ্টির আভাস রয়েছে। বৃষ্টির পর ২৬ জানুয়ারি থেকে তাপমাত্রা আরও কমার শঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মঙ্গলবার দেশের ২৬ অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ। চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও ১০ ডিগ্রির নিচে থাকা অঞ্চলগুলো হচ্ছে- পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ৭.১; কুড়িগ্রামের রাজারহাট, ভুরুঙ্গামারী ও ফরিদপুরে ৭.৫; রাজশাহী ও গোপালগঞ্জে ৭.৮; পাবনার ঈশ্বরদীতে ৮; মাদারীপুরে ৮.৩; বরিশাল, দিনাজপুর ও সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ৮.৪; নীলফামারীর ডিমলা ও টাঙ্গাইলে ৮.৫; যশোর, নীলফামারীর সৈয়দপুর ও কিশোরগঞ্জের নিকলীতে ৮.৬; কুষ্টিয়ার কুমারখালী, নওগাঁর বদলগাছী ও বগুড়ায় ৯; সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ৯.২; খুলনা ও চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে ৯.৪; ভোলা ও সাতক্ষীরায় ৯.৫; রংপুরে ৯.৬ এবং কুমিলস্নায় ৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি হলে সেখানে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটিকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ, ৪ থেকে ৬ ডিগ্রির মাঝে হলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ এবং চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে হলে তাকে অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। সেই হিসাবে চুয়াডাঙ্গাসহ ৭ অঞ্চলে বইছে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ, বাকিগুলোতে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইছে। হাড়কাঁপানো শীত ও উত্তরের হিমেল হাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে চুয়াডাঙ্গার জনপদ, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এদিকে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়া জনপদের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাসের সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তীব্র শীতে ভোগান্তি বেড়েছে খেটে যাওয়া সাধারণ মানুষের। বাড়ছে শীতজনিত রোগব্যাধি। রোদ ঝলমলে ঢাকায় ভোগান্তি : পৌষের শেষভাগ থেকে তীব্র শীতের কবলে পড়ে ঢাকাবাসী। তবে গত কয়েকদিন ধরে ঘন কুয়াশার সঙ্গে যোগ হয়েছে হিমেল হাওয়া, যা শীতের প্রকোপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও রেকর্ড করা হয়েছে। এতে করে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে রাজধানীর স্বল্প আয়ের মানুষ ও ছিন্নমূলদের অবস্থা বেশ শোচনীয়। মঙ্গলবার সকালে আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবুল কালাম মলিস্নক বলেন, 'আজ দেশের ২৬টি অঞ্চলের ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। শীতের প্রকোপ দেখা দিয়েছে রাজধানী ঢাকাতেও। মঙ্গলবার সকালে ঢাকার আকাশ বেশ রৌদ্রজ্জ্বল দেখা গেলেও তাপমাত্রার পারদ নেমেছিল ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে; যা এই মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড। ঢাকায় সূর্যের দেখা মিললেও দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলই এখনও কুয়াশায় আচ্ছন্ন। তবে ঢাকাসহ সারা দেশে রাতের তাপমাত্রা কিছুটা বাড়তে পারে।' তিনি জানান, মঙ্গলবার রেকর্ড হওয়া ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন রেকর্ড হলেও এটিই ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নয়। এর আগে ১৯৯৫ সালের ৩ জানুয়ারি তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ৬.৫ ডিগ্রিতে। এছাড়া ২০২১ সালে ১ ফেব্রম্নয়ারির তাপমাত্রা ছিল ১০ ডিগ্রি। তিনি বলেন, 'আজ রাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়তে পারে। এতে কিছু এলাকার শৈত্যপ্রবাহ কমে আসতে পারে।' তবে ২৬ তারিখ থেকে তাপমাত্রা আবারও কমে যেতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। \হ শীতে দুর্ভোগ বেড়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অন্যদিকে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় কষ্টে আছে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ। শীতের দাপটে ঠান্ডাজনিত রোগে ভুগছেন শিশু ও বয়স্করা। ছিন্নমূল ও খেটে খাওয়া মানুষ পড়েছেন সবচেয়ে বেশি বিপাকে। পাশাপাশি বোরো বীজতলা এবং অন্যান্য ফসল নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন এসব অঞ্চলের চাষিরা। এক দিনের ব্যবধানে জেলার তাপমাত্রার পারদ নেমে এসেছে ৬.৬ ডিগ্রিতে; যা সোমবার সকালে ছিল ৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাত ৯টায় ছিল ১০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের সিনিয়র আবহাওয়া পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান বলেন, 'মঙ্গলবার সকাল ৬টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৬.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তখন বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৬ শতাংশ। আর সকাল ৯টায় রেকর্ড করা হয় ৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একইসঙ্গে শুরু হয়েছে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। তিনি আরও জানান, এর আগে ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি এ জেলার তাপমাত্রা ৬.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। আর ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি এযাবৎকালের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩.৯ ডিগ্রি। এদিকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহে চুয়াডাঙ্গার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে জেলা শিক্ষা অফিস। তবে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে খোলা ছিল কিন্ডারগার্টেন ও প্রি-ক্যাডেট স্কুল। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার তবিবুর রহমান জানান, 'সোমবার চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। স্থানীয় আবহাওয়া অফিসের সঙ্গে কথা বলে তাপমাত্রা আরও কমার পূর্বাভাস পাওয়ায় খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালকের নির্দেশে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় আজ বন্ধ রয়েছে।' জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আতাউর রহমান জানান, তীব্র শীতের কারণে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা মাথায় রেখে বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে শিক্ষকরা স্কুলে উপস্থিত হয়ে দাপ্তরিক কার্যক্রম চালাবেন। পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, রৌদ্রজ্জ্ব্বল দিনে মঙ্গলবার সকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করেছে তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার। আবহাওয়া অফিসের হিসাবে সর্বনিম্ন এই তাপমাত্রা মানে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। গত সোমবার এখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একদিনের ব্যবধানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কমেছে ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যাওয়ায় মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছেন জেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ সাইফুল মালেক। এর আগে গত সোমবার দুই দিনের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। এদিকে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেশি ওঠানামা করার কারণে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। প্রকৃতির এমন বিরূপ আচরণের শিকার হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের জায়গা নেই। রুমের মেঝে ছাড়াও বারান্দাতেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে রোগীদের। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছেন। ঠান্ডাজনিত এসব রোগ এড়িয়ে চলতে সচেতন থাকার পাশাপাশি শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে বাড়তি যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ বলেন, 'মেঘলা আকাশে সূর্যের তাপ না থাকাসহ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা হিমেল বাতাসের কারণে পঞ্চগড়ে বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে। চলতি মাসের শেষের কয়েকটা দিন এমন আবহাওয়া বিরাজ করবে। এরই মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় বৃষ্টি হলে মেঘ কেটে কড়া রোদের কারণে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। তবে রাতে শীত অনুভূত হবে। ফেব্রম্নয়ারির প্রথম সপ্তাহের পর থেকে আস্তে আস্তে শীত কমতে থাকবে।' গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, প্রচন্ড শীতের কারণে গাইবান্ধা জেলার জনজীবন বিপর্যস্ত। ঘন কুয়াশা, হিমেল হাওয়া ও সেই সঙ্গে মৃদু শৈত্যপ্রবাহে স্থবির জনজীবন। জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে একদিনের জন্য পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসায় ছুটির এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার হারুনুর রশিদ। রংপুর আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'সকালে গাইবান্ধার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি চলতি শীত মৌসুমে জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। তবে চলতি সপ্তাহে উত্তরাঞ্চলের সব জেলার তাপমাত্রা আরও কমার আশংকা রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টা আগেও জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।' ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দুই সপ্তাহ পর সোমবার সূর্যের মুখ দেখা গেলেও মঙ্গলবার আবারও ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় ঠাকুরগাঁও। সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহীন আখতার জানান, তীব্র শীতের কারণে বুধ ও বৃহস্পতিবার ঠাকুরগাঁওয়ের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুই দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হিমালয়ের পাদদেশ সংলগ্ন ঠাকুরগাঁও জেলা একদিন পরে আবার বেড়েছে শীতের তীব্রতা। সকাল থেকে ঘন কুয়াশার সঙ্গে বইছে হিমেল হাওয়া, ঝিরঝির করে ঝরছে কুয়াশা। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন এখানকার খেটে খাওয়া ও কর্মজীবী মানুষ। কাজে বের হতে পারছেন না অনেকেই। বিপাকে পরেছেন ছিন্নমূল ও দুস্থ মানুষ। গরম কাপড়ের অভাবে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন অনেকেই। অনেক যানবাহন দিনের বেলায়ও হেড লাইট জালিয়ে চলছে। সর্দি, কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়াসহ বাড়ছে শীত ও শীতজনিত নানা রোগ। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকেই। কুড়িগ্রাম ও ভূরুঙ্গামারী, (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, মাঘের তীব্র শীতে বিপর্যস্ত কুড়িগ্রামের জীবনযাত্রা। মঙ্গলবার সকাল ৭টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৭.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস; যা জেলার এ বছরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। সোমবার জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৮.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘন কুয়াশার কারণে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। তীব্র ঠান্ডায় খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন মানুষজন। তাপমাত্রা নিম্নগামী হওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন চরাঞ্চলের নিম্ন আয়ের লোকজন। জীবন-জীবিকার তাগিদে কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করেই কাজে বের হচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষজন। বিপাকে পড়েছেন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমরসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকার চরাঞ্চলের মানুষজন। কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১২টি বেডের বিপরীতে চিকিৎসা নিচ্ছে প্রায় ৬০ জন রোগী। অন্যদিকে শিশু ওয়ার্ডে ৪৪টি বেডের বিপরীতে চিকিৎসা নিচ্ছে প্রায় ৯০ জন রোগী। তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকায় গত বৃহস্পতিবার থেকে বন্ধ রয়েছে জেলার মাধ্যমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ের দুই হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসা বিভাগ জানিয়েছে, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশিসহ শীতজনিত নানা উপসর্গ নিয়ে গত দুই দিনে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী। মঙ্গলবার সকাল থেকে ডায়রিয়া নিয়ে ভূরুঙ্গামারী সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে অন্তত ২২ শিশু। কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের রিকশা চালক সুজন বলেন, 'কিছুদিন থাকি ঠান্ডা খুব পড়ছে। আজও খুব ঠান্ডা। রাস্তায় লোকজনও কম। আগের মতো আর যাত্রী হচ্ছে না। ঠান্ডার কারণে আয় অনেক কমে গেছে। যতই ঠান্ডা হোক না কেন আমার গাড়ি নিয়ে বাহির হতেই হয়। কুড়িগ্রামের রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, 'জানুয়ারি মাসজুড়েই তাপমাত্রা এরকম থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ মাসের ২৫ তারিখের পর তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে।'
মেহেরপুর প্রতিনিধি জানান, তীব্র শীতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উত্তরের হিমেল হাওয়ার পাশাপাশি রাত থেকে সকাল পর্যন্ত কুয়াশাছন্ন থাকছে আকাশ। গত দুই দিন ধরে তাপমাত্রা নিচের দিকে। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন দিনমজুররা। প্রতিদিনের আয়েও ভাটা পড়েছে তাদের। পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনো রকমেই সংসার চালাতে হচ্ছে। অনেকে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।
চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ২০-২১ জানুয়ারি তাপমাত্রা ১২-১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করলেও ২২ জানুয়ারি থেকে তাপমাত্রা কমছে। মঙ্গলবার সকাল ৬টায় মেহেরপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৬.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এদিক তাপমাত্রা নেমে যাওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
পাবনা প্রতিনিধি জানান, মঙ্গলবার ঈশ্বরদীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৮ ডিগ্রি। তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ও তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় বুধবার পাবনা জেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ নিয়ে টানা তৃতীয় দিনের মতো পাবনার ১ হাজার ৬৬৪টি বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হলো।
মঙ্গলবার বিকালে পাবনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সিদ্দিক মোহাম্মদ ইউসুফ রেজার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে জেলা শিক্ষা অফিসার রোস্তম আলী হেলালী স্বাক্ষরিত পৃথক আরেক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে থেকেও একই কারণে একইদিনে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রেও এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
এর আগে সোমবার ৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও রোববার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে এ জেলায়।
অন্যদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মৌলভীবাজার, বরিশাল, ভোলা ও কুমিল্লা জেলাসহ ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা কিছু জায়গায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে অব্যাহত থাকতে পারে এবং কিছু জায়গায় হতে কমে আসতে পারে।
ঢাকা এবং ঢাকার আশেপাশের অঞ্চলের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা থাকতে পারে। আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে, একই সঙ্গে এ সময় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা থাকতে পারে। এছাড়া কখনও কখনও উত্তর বা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার শীতের কনকনে বাতাস বেগে প্রবাহিত হতে পারে। দিনের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও আশেপাশের এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে।
আগামী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, খুলনা বিভাগের দু-এক জায়গায় হালকা বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্য এলাকায় আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে তা কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ এবং সড়ক যোগাযোগে বিঘœ ঘটতে পারে। সারাদেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য কমে যাওয়া। এটি যত কমে আসবে তত শীতের অনুভ‚তি বাড়বে।
আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান জানান, আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী ফেব্রæয়ারিতে আরও একটি শৈত্যপ্রবাহ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
তিনি জানান, গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শীত পড়েছিল ২০১৮ সালে। সে বছরের ৮ জানুয়ারি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা ছিল ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ইতিহাসে রেকর্ড। সে সময় তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গিয়েছিল। সে হিসেবে এবার তীব্র শৈত্যপ্রবাহ না হলেও শীতের অনুভ‚তি অনেক বেশি।