চলমান গ্যাস সংকট এখন বিদু্যৎ খাতের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই গ্যাসভিত্তিক বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ নেমেছে অর্ধেকে। এমনকি শীতেই গড়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করছে বিদু্যৎ বিভাগ। এছাড়াও আমদানিকৃত গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হতে আরও সময়ের প্রয়োজন। এ অবস্থায় গ্যাসের জোগান না পেলে ব্যাহত হতে পারে সামগ্রিক বিদু্যৎ উৎপাদন। অন্যদিকে বিকল্প জ্বালানিতে বাড়বে উৎপাদন ব্যয়।
জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন দ্রম্নত সময়ের মধ্যে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করবে। কারণ ফেব্রম্নয়ারি থেকেই বিদু্যতের চাহিদা বাড়তে থাকবে; তখন গ্যাসের বিকল্প জ্বালানির প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু বর্তমান ডলার মূল্য ও জ্বালানির দামের অস্বাভাবিক ওঠানামা এ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে দেবে কয়েক গুণ। যা দেশের শিল্পসহ সামগ্রিক উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেবে, বাড়বে মূল্যস্ফীতিও।
এ দিকে দেশের উৎপাদিত বিদু্যতের প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি গ্যাসভিত্তিক। মূলত কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদু্যতের থেকে গ্যাসে উৎপাদন ব্যয় ৫০ শতাংশ কম। বর্তমানে পণ্য পরিবহণে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রুটে বাড়তি শুল্ক স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ও জ্বালানি তেল আমাদনি ব্যয়ে গুনতে বাড়তি অর্থ। সেই হিসেবে বিকল্প জ্বালানিতে
\হবিদু্যৎ পেতে গ্রাহকের ওপর চাপ বাড়বে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বর্তমানে দেশে বিদু্যতের গড় চাহিদা প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট এবং উৎপাদন সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট। ফলে গড়ে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এদিকে গত বছরের এই সময়ের এবার তুলনায় চাহিদা বেড়েছে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট। সেই হিসেবে মার্চে এই চাহিদা ১৪ হাজার এবং এপ্রিলে ১৬ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়াও আবাসিক ও ক্ষুদ্র শিল্পে গ্যাসের সংকট থাকায় চাপ বাড়বে বিদু্যতের ওপর। যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে।
এদিকে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিকের আশ্বাস দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে এলএনজি সরবরাহ স্বাভাবিক হতে মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এলএনজি টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণের কারণে চলমান সরবরাহ আরও দুই মাস স্থায়ী হতে পারে। তারা জানান নভেম্বর থেকে দু'টি পাইপলাইনের একটির রক্ষণাবেক্ষণের শুরু হয়েছে, যা প্রায় শেষ পর্যায়ে, এটি চালু হইে অন্যটির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু হবে। এতে অন্তত দুই মাস সময় লাগতে পারে। সে হিসেবে দু'টি পাইপলাইন দিয়ে এলএনজি সরবরাহ নিশ্চিত না হলে আগামী মার্চ বা এপ্রিলের আগে গ্যাস-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এদিকে আমদানিকৃত গ্যাসের ২০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় বিদু্যৎ উৎপাদনে। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে বিদু্যৎ উৎপাদনে গ্রীষ্মে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের গ্যাসের চাহিদা থাকে, তবে বর্তমা ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সক্ষমতা সম্পন্ন বিদু্যৎ কেন্দ্র উৎপাদনে রয়েছে কিন্তু সরবরাহ রয়েছে মাত্র ৩০০ এমএমসিএফডি। অর্থাৎ শীতে অর্ধেক কেন্দ্রে চালু থাকলে গ্যাসের ঘাটতি প্রায় ৬০ শতাংশ।
যদিও বিদু্যৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদু্যৎ উৎপাদন অব্যাহত থাকবে। সে ক্ষেত্রে কয়লাকেই প্রধান বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ধরা হয়েছে। দেখা গেছে মাতারবাড়ি, পায়রা ও রামপালের কয়লাভিত্তিক তাপ বিদু্যৎ কেন্দ্র থেকে গড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট এবং ভারতের আদানি থেকে আর ১ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যৎ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাকি প্রায় ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যতের ৮০ শতাংশের উৎস যায় গ্যাসে।
অন্যদিকে ডলার সংকট বা অন্য কোনো কারণে সামনে যদি সরবরাহ ঠিক না থাকে, বিকল্প হিসেবে বিদু্যৎ উৎপাদনে নিজস্ব গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সেক্ষেত্রে বাসাবাড়ি ও শিল্প কারখানায় জোন ভাগ করে রেশনিং গ্যাস সরবরাহ করা হতে পারে বলেও জানান তিনি।
পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমতুলস্নাহ মতে বর্তমানে যে গ্যাসের সরবরাহ রয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন সম্ভব। যদি গ্যাসের (আমদানি, নিজস্ব) সরবরাহ আরও বাড়ানো হয় তাহলে অন্যান্য খাত মুখথুবড়ে পড়েবে। প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে চাপে ফেলবে অর্থনীতিকে। যায়যায়দিনকে তিনি বলেন, অন্যান্য খাতে গ্যাস কমিয়ে যদি বিদু্যতে সরবরাহ করা হলেও বিদু্যৎ বাবদ গ্রাহকের ব্যয় কয়েক গুণ বাড়বে। এছাড়াও ডলার ও পরিবহণ খরচ বৃদ্ধিতে চারটি বিদু্যৎ কেন্দ্রের কয়লা আমদানি ব্যয় অন্তত ৩০ শতাংশ বাড়বে। একইভাবে এলএনজি সরবরাহ স্বাভাবিক হলে এ খাতে আগের থেকে ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। যদিও আপাতত গ্যাস বিদু্যতের দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী। সে ক্ষেত্রে বিদু্যৎ বিভাগের কাছে বেসরকারি উৎপাদনকারীদের চাপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও জানান তিনি।