বৈধ গুদামে অবৈধ মজুত
প্রশাসনের দুর্বল নজরদারির সুযোগে মজুতকারী চক্র প্রায়ই লাখ লাখ টন ধান-চাল মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। মজুতদার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এসব পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে
প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার পাইকপাড়ার ওরিয়েন্টাল অ্যাগ্রোর একটি গুদামে অভিযান চালিয়ে সম্প্রতি ২৭০ মেট্রিক টন ধান জব্দ করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী জেলা খাদ্য কর্মকর্তা জানান, এ প্রতিষ্ঠানটি আট মাস আগে কয়েকটি গোডাউনে আঠাশ জাতের ধান মজুত করে সম্প্রতি ধান-চালের দাম বাড়ার পর তা গোপনে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করছিল।
একই দিন নওগাঁর মান্দা উপজেলার তারামন ট্রেডার্স, শেখ ট্রেডার্স ও হাজি ট্রেডার্স নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানের বৈধ গুদামে অভিযান চালিয়ে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত অবৈধভাবে মজুতকৃত ১ হাজার টন ধান পাওয়া যায়। এর আগে মঙ্গল ও বুধবার একই জেলার নিয়ামতপুর ও মহাদেবপুরে মজুতবিরোধী অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত করায় সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু এই কয়েকটিতেই নয়, মজুতের জন্য খাদ্য অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নেওয়া হাজার হাজার বৈধ গুদামে নির্ধারিত পরিমাণের কয়েক গুণ বেশি ধান-চাল সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া খাদ্য মজুতের জন্য সর্বোচ্চ যে সময় নির্ধারিত, সেটিও মানা হচ্ছে না। যা মজুতদারি আইনে অবৈধ। এ অপরাধে ফৌজদারি আইনে মামলা এবং জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ প্রশাসনের দুর্বল নজরদারির সুযোগে মজুতকারী চক্র প্রায়ই লাখ লাখ টন ধান-চাল অবৈধভাবে মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। মজুতদার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এসব পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে।
এদিকে নিত্য এ খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে শুধু দেশব্যাপী হইচই শুরু হলেই প্রশাসনের টনক নড়ছে। তবে মজুতকারীদের বিরুদ্ধে ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিযান শুরু করা হলেও ক'দিন না যেতেই তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আইনকে থোরাই কেয়ার করে মজুতকারী চক্র দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এ সিন্ডিকেট প্রায়ই চালের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেটের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ এদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ দূরে থাক, কৌশলে তাদের লাগাম টেনে ধরতেও প্রশাসন ভয় পাচ্ছে।
স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনেকের অভিযোগ, মজুতকারী চক্রের সঙ্গে গোপন আঁতাত থাকায় মূলত প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাই তাদের সুযোগ করে দিচ্ছেন। এছাড়া এর নেপথ্যে রাজনৈতিক নেতাদেরও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ
\হমদত রয়েছে। ফলে মজুতকারী চক্রের হোতাদের তালিকাও অপ্রকাশিত থাকছে।
অথচ সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া পরিমাণের চেয়ে বেশি খাদ্যদ্রব্য মজুত করলে যাবজ্জীবন বা সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং অর্থদন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে। আর এই অপরাধ হবে অজামিনযোগ্য। এ বিধান রেখে গত বছরের ৫ জুলাই একটি নতুন আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়।
ওই সময় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার 'খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহণ, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) বিল-২০২৩' পাসের জন্য জাতীয় সংসদে তোলেন। বিলের ওপর আনা জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি শেষে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। মূলত ১৯৫৬ সালের ফুড (স্পেশাল কোর্ট) অ্যাক্ট এবং ১৯৭৯ সালের ফুডগ্রেইনস সাপস্নাই (প্রিভেনশন অব প্রিজুডিশিয়াল অ্যাকটিভিটি) অর্ডিন্যান্স বাতিল করে নতুন এ আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ওই বিলে বলা হয়, খাদ্যদ্রব্য বলতে বোঝাবে যেকোনো প্রকার দানাদার খাদ্যদ্রব্য; যথা চাল, ধান, গম, আটা, ভুট্টা ইত্যাদি। বিলে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সরকার নির্ধারিত পরিমাণের বেশি খাদ্যদ্রব্য মজুত করলে বা মজুতসংক্রান্ত সরকারের নির্দেশনা অমান্য করলে সর্বোচ্চ সাজা পাবেন। অবশ্য শর্ত রয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে তিনি আর্থিক বা অন্য কোনো প্রকার লাভের উদ্দেশ্য ছাড়া মজুত করেছিলেন, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদন্ড এবং অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, খাদ্যদ্রব্য মজুত আইনে অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দেওয়ার বিধান থাকলেও এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। এমনকি অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে তাদের তালিকা কখনো তৈরি করা হয়নি। এ ব্যাপারে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় পর্যায়ের সোর্স নিয়োগের নজিরও নেই বললেই চলে। বরং বিভিন্ন সময় মজুতকারী চক্রের কাছেই অবৈধ মজুতের তথ্য চাওয়া হয়েছে।
তাদের এ অভিযোগ যে অমূলক নয়, তা সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সম্প্রতিক বক্তব্যে অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। গত সোমবার রাজশাহী জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে বিভাগীয় ও বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও মিলস মালিকদের এক সভায় মন্ত্রী মিলারদের কাছে ধান ও চালের অবৈধ মজুতের তথ্য চান। অথচ বাজার পর্যবেক্ষকরা বরাবরই অবৈধভাবে ধান-চাল মজুতের জন্য অন্যদের পাশাপাশি মিলারদেরও দায়ী করে আসছেন। বিভিন্ন অভিযানে মিলারদের গুদামে অবৈধভাবে মজুতকৃত বিপুল পরিমাণ ধান-চাল পাওয়া গেছে।
এদিকে বাজার পর্যবেক্ষকদের অভিযোগের প্রমাণ এবার হাতেনাতেই পাওয়া গেছে। গত শনিবার নওগাঁ সদর, মহাদেবপুর ও পত্নীতলায় অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত রাখার অপরাধে জেলা চালকল মালিক গ্রম্নপের সভাপতিসহ ১২ জন ব্যবসায়ীকে ৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
মহাদেবপুরের পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্রে জানা গেছে, মহাদেবপুর উপজেলার নাহার আরমান অটোমেটিক রাইস মিলের গুদামে এক মাসের বেশি সময় ধরে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ধান মজুত রাখায় প্রতিষ্ঠানটির মালিককে ৩০ হাজার টাকা; উপজেলার শাপলা অটো রাইস মিলের গুদামে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি চাল ১৫ দিনের বেশি সময় ধরে মজুত থাকায় প্রতিষ্ঠানের মালিককে ২০ হাজার টাকা এবং দাদা অটোমেটিক রাইস মিলের গুদামে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি আতপ চাল ১৫ দিনের বেশি সময় ধরে মজুত রাখায় মিলের মালিককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এছাড়া নওগাঁ শহরের মেসার্স তছিরন অটোমেটিক রাইস মিলের গুদামে অবৈধভাবে চাল মজুতের দায়ে কৃষি বিপণন আইন ২০১৮-এর ১৯(ঠ) ধারায় মিল মালিককে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। শহরের আনন্দনগর এলাকায় মেসার্স আর এম রাইস মিলের গুদামে অবৈধভাবে চাল মজুতের দায়ে মিল মালিক ও জেলা চালকল মালিক গ্রম্নপের সভাপতি রফিকুল ইসলামকে কৃষি বিপণন আইন ২০১৮-এর ১৯(ঞ) ও (ঠ) ধারার এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ওই মিলের তিনটি গুদাম সিলগালা করা হয়েছে। এ ছাড়া রফিকুল ইসলামের স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠান মেসার্স জায়েদা ট্রেডার্সকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এদিকে ধান-চালের ভর মৌসুমে অস্বাভাবিক হারে চালের দাম বৃদ্ধির জন্য বাজার পর্যবেক্ষকরা বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তাদের ভাষ্য, কিছু কিছু করপোরেট হাউস ও বড় বড় মিল মালিক ধান-চাল মজুত করেছে। ফলে মজুত ও সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হওয়ায় চালের দাম বেড়েছে। এছাড়া গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রশাসন নির্বাচনী ব্যস্ততার কারণে দ্রব্যমূল্যের মনিটরিংয়ে খুব একটা নজর দিতে পারেনি। এ সুযোগে বাজার সিন্ডিকেট নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে বাজারে চালের দাম বাড়িয়েছে। আবহাওয়া খারাপ হওয়ার কারণে চাতাল মালিকরা ধান শুকাতে না পারায় চালের দাম কিছুটা বাড়তে পারে বলে মনে করেন তারা।
তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, চালের দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে এসবের বাইরে আরও বেশকিছু কারণ রয়েছে। যা খাদ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সবারই জানা। অথচ এসব ব্যাপারে তারা বরাবরই উদাসীন। এ কারণে লোক দেখানো অভিযানে সাময়িক সুফল মিললেও তা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। মজুতকারী সিন্ডিকেট কিছুদিন পরপরই নানা কারসাজিতে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে।
সংশ্লিষ্ট দাবি, সারাদেশে ধান-চালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের হাজার হাজার অবৈধ গুদাম রয়েছে। সেখানে মাসের পর মাস বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত করে রাখা হচ্ছে। বিষয়টি 'ওপেন সিক্রেট' হলেও খাদ্য অধিদপ্তর বরাবরই এ ব্যাপারে চোখ বুঁজে থাকছে।
তবে সম্প্রতি স্থানীয়দের চাপে মৌলভীবাজারের একটি অবৈধ গুদাম সিলগালা করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। জানা গেছে, জুড়ী উপজেলার ইট ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম পুরোনো একটি গুদাম ভাড়া নিয়ে অবৈধভাবে ধান মজুত করে ব্যবসা করছিলেন। গত বৃহস্পতিবার স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই গুদামে অভিযান চালিয়ে তাকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেই সঙ্গে গুদামটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। তার গুদামে ৬০ মেট্রিক টন ধান মজুত পাওয়া যায়। যার বাজারমূল্য ২০ লক্ষাধিক টাকা।
নওগাঁর একাধিক জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন এলাকায় কয়েকশ' অবৈধ গুদাম রয়েছে। বিষয়টি খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও জানেন। অথচ রহস্যজনক কারণে তারা সেখানে কোনো অভিযান চালান না। তবে ধান-চালের দাম আকস্মিক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পর স্থানীয়রা খাদ্য অধিদপ্তরকে এ ব্যাপারে চাপ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি গুদামে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে এসব অবৈধ মজুতকারীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদে অভিযান চালানো হবে কিনা তা নিয়ে তারা সংশয় প্রকাশ করেন।