জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে বাস্তুচু্যতের সংখ্যা
প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে রেকর্ডসংখ্যক মানুষ বাস্তুচু্যত হচ্ছেন। আগামী দিনগুলোতে এ সংখ্যা তিনগুণ হতে পারে বলছেন জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর। ইতোমধ্যে দেশে ৬০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গবেষণা মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি ৭ জনে একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচু্যত হবেন। এ হিসাবে ২০৫০ সালে দেশে বাস্তুচু্যত মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৩০ লাখ।
বাস্তুচু্যতের ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালে বিশ্বে রেকর্ড ১১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছে। ২০২৪ সালে ১৩ কোটি মানুষ আশ্রয় হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। এর আগে কখনো বিশ্বে এক বছরে এত সংখ্যক মানুষ আশ্রয়হীন হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। গেল বছরটিতে সর্বোচ্চ মানবিক বিপর্যয়ের সাক্ষী হয়েছেন বিশ্ববাসী। তুরস্ক ও সিরিয়ায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্প, সুদানের সামরিক বাহিনী ও আধাসামরিক আইএসএফের সংঘাত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় মোচা, গাজায় হামাস-ইসরাইল যুদ্ধসহ বিভিন্ন ঘটনায় মানুষ বেশি বাস্তুচু্যত হয়েছেন।
শুক্রবার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ইউএনএইচসিআরের এক্সটার্নাল রিলেশন্স বিভাগের পরিচালক ডমিনিক হাইড বলেছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈরী আবহাওয়ার পাশাপাশি সংঘাত ও মানবাধিকার লঙ্ঘন কোটি কোটি পরিবারকে বাস্তুচু্যত করার পাশাপাশি ত্রাণ ও মানবিক সহায়তার জন্য হাত পাততে বাধ্য করেছে। সাধারণত ২০২৩ সালে দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের কারণে বিশ্বের অজস্র মানুষ যে ভয়াবহ ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা এক কথায় 'অবর্ণনীয়'। আশঙ্কার বিষয় হলো, চলতি বছর এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ নেচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. এস.এম. মনজুরুল হান্নান খান বলেন, প্রাকৃতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু বাস্তুচু্যত সংখ্যায়ও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রকৃতির বৈরী আচরণে মানুষ বাস্তুচু্যত হচ্ছেন। জলবায়ুর প্রভাবে, বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মিঠাপানির উৎস ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অনেক এলাকায় কৃষি উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে জীবিকা হারিয়েছেন অনেকে। জীবিকার সন্ধানে প্রথমে তারা বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রামে আসে। তারপরও কর্ম না পাওয়ায় অনেকে ঢাকায় আসছেন। ঢাকার বস্তি ও রাস্তায় তারা ঠাঁই নিচ্ছেন। সীমান্ত পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশেও যাচ্ছেন অনেকে। মানুষের বসবাসের বাস্তুচু্যত ঘটার আরেকটি বড় কারণ হলো বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একাধিক ঘূর্ণিঝড়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এসব ঝড়ের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে। ঘূর্ণিঝড়ে সব হারিয়ে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিবছর নদীভাঙনেও অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে বাস্তুচু্যত হচ্ছে। দেশে প্রতিদিন আড়াই হাজার মানুষ জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচু্যত হচ্ছেন।
সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গবেষণা মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি ৭ জনে একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুচু্যত হবেন। এ হিসাবে ২০৫০ সালের মধ্যে বাস্তুচু্যত মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৩০ লাখ। এ তথ্য কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচু্যত ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছেন। জাতীয় কৌশলপত্রে বাস্তুচু্যতির জন্য উপকূল ছাড়া অন্যান্য এলাকায় মূলত বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে বাস্তুচু্যত হচ্ছেন। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নিয়মিত খরা হচ্ছে। পানি সংকট তীব্র হচ্ছে। ফসল নষ্ট হচ্ছে। উপকূলে নদীভাঙনে কর্ম হারিয়ে অভাবের তাড়নায় মানুষ বাস্তুচু্যত হচ্ছেন। ভূতাত্ত্বিকভাবে বড় ভূমিকম্পের
দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। ভারতীয় টেকটোনিক পেস্নটের উত্তর-পূর্ব কিনারে বাংলাদেশের অবস্থান। ভূমিকম্পও শহর ও উপশহরগুলোতে বড় আকারে বাস্তুচু্যতি ঘটাতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সিডর ও আইলার পর দেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। ঘূর্ণিঝড় সিডরে ছয় লাখ ৫০ হাজার, ঘূর্ণিঝড় বিজলিতে প্রায় ২০ হাজার এবং ঘূর্ণিঝড় আইলার কারণে আট লাখ ৪২ হাজার মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছেন। জলবায়ু বাস্তুচু্যত এই সংখ্যা ২০৩০ সালে চার কোটি ৮৩ লাখ এবং ২০৪০ সালে তা ৯ কোটি ৫৭ লাখে দাঁড়াতে পারে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে বসবাসরতদের ৮১ শতাংশই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচু্যত।
এদিকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অলিগলি, বস্তি বা ফুটওভার ব্রিজের নিচে রাত কাটাচ্ছেন বাস্তুচু্যত লাখ লাখ মানুষ। জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমও, ইন্টারনাল ডিসপেস্নসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এমন কয়েকটি পরিবার বসবাস করছেন রাজধানীর তালতলা এলাকায়। শৈত্যপ্রবাহের এক দুপুরে কথা হয় সুরমা বেগমের সঙ্গে। তার কোলে ছোট্ট একটি ফুটফুটে সন্তান। শাড়ির আঁচলে শিশুটির মুখ ঢাকা। তিনি বাচ্চাটির দুধ কেনার জন্য বাসযাত্রীদের কাছে হাত পাতছেন। বাস থেকে নেমে কথা হয় সুরমা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরে তাদের ঘরবাড়ি সবই ছিল। সিডর-আইলা তাদের সব নিছে। বাবা মারা গেছে বহু আগেই। মা অচল। কাজের আশায় মা ও দুই বোন নিয়ে তিনি ঢাকায় আসেন। আশ্রয় নেন চন্দ্রিমা উদ্যানে। পুলিশ রাতে বের করে দেয়। এরপর আগারগাঁও, পুরনো বিমানবন্দর, চন্দ্রিমা উদ্যান আর বিজয় সরণির ফুটপাতই হয়ে ওঠে তাদের ঘরবাড়ি। ছোট বোনটি ফুল বিক্রি ও পস্নাস্টিকের বোতল সংগ্রহের কাজ করলেও এখন সে নেশাগ্রস্ত।
তিনি বলেন, 'ভোলার রিকশাওয়ালা হাফিজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। বাচ্চা হবে শুনে লোকটা পালিয়ে গেছে। তিনমাস আগে আমার এই বাচ্চা হয় ওই গাছটার নিচে। নিজেই বাচ্চার নাঁড়ি কাটছি। ঠান্ডার কারণে বাচ্চার নিউমোনিয়া হইছে। ওষুধ কিনার জন্য বাসে বাসে টাকা চাই-স্যার।'
রাজধানীর মিরপুরের কালসী এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে একাধিক বাস্তুচু্যত পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। এক সময়ের ধনাঢ্য কৃষক সুরুজ আলী আম্পানে নিঃস্ব হয়ে দুই মেয়ে, বৃদ্ধ মা ও স্ত্রীকে নিয়ে বাস্তুচু্যত হয়েছেন। তাদের সহায়সম্বল বলতে এখন পাঁচ ফুটের একটি নীল রঙের পলিথিন, কয়েক টুকরা সুতলি আর চারটি ইট দিয়ে তৈরি তাদের ঘর। বৃষ্টিতে ভিজে আর রোদে পুড়ে পরিবারের সবাই। খুপড়িতে একসঙ্গে সবাই শুতে পারে না। পালা করে ঘুমায় তারা। বৃদ্ধ সুরুজ আলী একবেলা রিকশা চালান। আর মেয়ে দুটি ১১ নম্বর বাজারে ফেলে দেওয়া পচা সবজি কুড়িয়ে আনে। রাস্তায় ফেলে দেওয়া পস্নাস্টিকের বোতল, পলিথিন ও কাগজ হচ্ছে তাদের রান্নার জ্বালানি। খাবার পানির জন্য মসজিদের পানির লাইন থেকে গভীর রাতে পানি চুরি করেন তারা। আর রান্নাবান্নাসহ অন্যান্য কাজে ড্রেনের ময়লা পানিই ব্যবহার করেন তারা। সপ্তাহ পার হলেও তাদের গোসল জোটে না। সংসারে আয়-রোজগার বাড়াতে ভিক্ষার জন্য বৃদ্ধ মাকে রাস্তায় বসিয়ে রাখেন সুরুজ আলী। মানুষ যে দান-খয়রাত করে, তা দিয়ে বৃদ্ধের ওষুধের টাকা হয়ে যায়। সুরমা বেগম ও সুরুজ আলীর গল্প বাস্তুচু্যত মানুষের প্রায় একই রকম। রাজধানীর মিরপুর কালসী. দশ নম্বর গোল চত্বর, এক নাম্বর, মহাখালী, তিব্বত, শামলী, সদরঘাট, ফার্মগেট, গুলিস্তান, মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলিতে চোখে পড়ে বাস্তুচু্যত পরিবার।
ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি শতকের মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে। দেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এতে প্রায় তিন কোটি মানুষ বাস্তুচু্যত হতে পারে। চলতি শতকের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা এক মিটার বাড়লে দেশের তিন হাজার ৯৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যেতে পারে। এসব এলাকার লাখ মানুষ নতুন করে ভিটেমাটি, জীবিকা ও কর্ম হারিয়ে বাস্তুচু্যত হতে পারেন।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্যমতে, জলবায়ু শরণার্থীদের একটি বড় অংশই শহরমুখী হচ্ছে অর্থনৈতিক কারণে। গবেষণা সংস্থা গ্রাউন্ডশেল আশঙ্কা প্রকাশ করে জানায়, ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় চার কোটি, লাতিন আমেরিকায় এক কোটি ৭০ লাখ এবং সাব-সাহারান অঞ্চলে আট কোটি ৬০ লাখ মানুষ জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হবে। গবেষকদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে এক কোটি ৩৩ লাখ বাংলাদেশি বাস্তুচু্যত পরিণত হবেন, যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ।