কারাবন্দি জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর উদ্যোগ

চালু হচ্ছে ডি-রেডিক্যালাইজেশন সেন্টার, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও নির্মূল হয়নি

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ম গাফফার খান চৌধুরী কারাবন্দি জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কারাগারে স্থাপন করা হচ্ছে ডি-রেডিক্যালাইজেশন সেন্টার। গাজীপুরের কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি জেলে স্থাপন করা হচ্ছে প্রথম সেন্টারটি। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চলতি বছরেই সেন্টারটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর কথা রয়েছে। সেন্টারটির মাধ্যমে জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা সূত্রে আরও জানা গেছে, দৃশ্যমানভাবে দেশে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও নির্মূল হয়নি। জঙ্গিবাদ নির্মূল করা কোনোভাবেই সম্ভবও না। কারণ এটি একটি আদর্শিক বিষয়। এজন্য জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদে জড়িতদের ব্রেইন ওয়াশ করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। ইতোপূর্বের্ যাব পরীক্ষামূলকভাবে এমন কার্যক্রম হাতে নিয়ে সফলতা পেয়েছে। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদে আসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যেভাবে উঠতি বয়সি তরুণ-যুবক-যুবতীদের ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের আকৃষ্ট করা হয়, ঠিক তেমনিভাবে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা দিয়ে উদ্বুদ্ধ হওয়াদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতেই ডির্-যাডিক্যাইলেজশন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পবিত্র ইসলাম ধর্মের যেসব নির্দিষ্ট বিষয়ের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মভীরু তরুণ-তরুণীদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়, সেসব বিষয়ের সঠিক ব্যাখ্যা সংবলিত পুস্তক লেখা হয়েছে। যা সমাজের বিশিষ্ট আলেম ওলামা ও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক বিষয়ে খ্যাতিসম্পন্ন সুপন্ডিত শিক্ষকদের দিয়ে লেখা হয়েছে। পুস্তকে সমাজের সর্বজন স্বীকৃত ও শ্রদ্ধেয় আলেমদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে। জিহাদ সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে কোন প্রেক্ষাপটে কি ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে সেই পুস্তকে। ডি-রেডিক্যালাইজেশন সেন্টারটি হবে অনেকটা রিহ্যাব সেন্টার বা সংশোধন কেন্দ্র। বিশিষ্ট অপরাধ ১ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদ পুরোপুরি মজ্জাগত বা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। একবার মগজে ঢুকলে সহজেই বের হতে চায় না। এমনকি জঙ্গিবাদে হাইলি মোটিভেটেডদের অনেক সময় বের করা সম্ভবও হয় না। জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদ এক ধরনের আসক্তিও বটে। টার্গেটকৃত তরুণ বা তরুণীদের জীবনের সর্বশেষ পরিণতি মৃতু্য সম্পর্কেই বেশি অপব্যাখা দেওয়া হয়। কারণ প্রাকৃতিক কারণেই প্রত্যেক জীবনেরই মৃতু্যর মধ্যদিয়ে অবসান হবে। জীবন অবসানের পর পরকাল সম্পর্কে টার্গেটকৃতদের ব্যাখা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, একজন তরুণ বা তরুণীকে যখন জীবনের শেষ পরণতি মৃতু্য ও পরকাল সম্পর্কে প্রতিনিয়ত বলা হয়, তখন তার মধ্যে এক ধরনের আধ্যাত্মিক মানসিকতা কাজ করে। শুধু তরুণ বা তরুণী নয়, অনেক স্বাভাবিক মানুষকেও নিয়মিত এসব বিষয়ে পরামর্শ বা ব্রেইনওয়াশ করা হলে তিনি পরকালের চিন্তায় বিভোর হয়ে যাবেন, এটিই স্বাভাবিক। পারলৌকিক মানসিকতাকে পূঁজি করেই টার্গেটকৃত তরুণ-তরুণীদের পবিত্র ইসলাম ধর্মের জন্য জিহাদ বা যুদ্ধ করতে অনুপ্রাণিত করা হয়। ঠিক ওই সময় ইসলামের বিভিন্ন যুদ্ধের ব্যাখা দেওয়া হয়। এভাবেই একজন তরুণ বা তরুণী আস্তে আস্তে জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদের দিকে আকৃষ্ট হতে থাকে। পরে তাদের আরও কয়েকটি ধাপে ব্রেইনওয়াশ করা হয়। এক পর্যায়ে তারা দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয় বা আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। জঙ্গিবাদের নানা বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, বর্তমানে দেশে জঙ্গিবাদ দৃশ্যমানভাবে নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে জঙ্গিবাদ নির্র্মূল হয়নি। এমনকি জঙ্গিবাদ কোনোদিনই নির্মূল করা সম্ভব নয়। কারণ এটি একটি আদর্শিক বিষয়। সুযোগ পেলেই যে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না, সেটি হলফ করে বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে নানাভাবে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানোর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত অব্যাহত আছে। দেশের সব জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে। তবে আগের মতো নেই। অত্যন্ত গোপনে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের প্রযুক্তিনির্ভর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। মাসিক চাঁদা আদায়, সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে সব কার্যক্রমই চালাচ্ছে অত্যন্ত সংগোপনে। অত্যন্ত সীমিত পরিসরে চলছে তাদের কর্মকান্ড। স্বাভাবিকভাবে তাদের তা চোখে পড়ার মতো নয়। সূদুরপ্রসারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, সেই পদক্ষেপের অংশ হিসেবেই কারাবন্দি জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ডির্-যাডিক্যালাইজেশন কর্মসূচি চালু করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা ও ইউনিট কার্যক্রম বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদ এক ধরনের আসক্তি। এই আসক্তি থেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ারা সহজেই বের হতে পারেন না। এজন্যই জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতেই সরকারের এমন উদ্যোগ। তিনি জানান, প্রথম ডি-রেডিক্যালাইজেশন সেন্টারটি চালু করা হবে গাজীপুর জেলার কাশিমপুরে অবস্থিত হাইসিকিউরিটি জেলে। কারণ এই জেলটিতেই সবচেয়ে দূর্ধর্ষ জঙ্গিদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়। চলতি বছরই সেন্টারটি চালুর কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত কাজ শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক জীবনে ফেরা জঙ্গিদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রয়েছে কর্মসূচিতে। র্ যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে বলেন, ২০১৬ সালে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও বেকারিকে জঙ্গি হামলার পরর্ যাবের হাতে প্রায় ৩ হাজার জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে। এ ছাড়ার্ যাব ইতোমধ্যে ২৭ জঙ্গিকে ডির্-যাডিক্যালাইজেশন কর্মসূচির আওতায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।র্ যাবের এমন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, হলি আর্টিজানে হামলার পর জঙ্গি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার জনকে। যাদের মধ্যে অনেকেই দুর্ধর্ষ জঙ্গি। দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের বাছাই করে রাখা হয়েছে গাজীপুরের কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটি জেলে। তারপরও ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে দিনদুপুরে জাগৃতি প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি হলেন- মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব। তারা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুলস্নাহ বাংলা টিম) সদস্য। প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট কুমিলস্না সদর থানা এলাকা থেকে একযোগে ৮ তরুণ নিখোঁজের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে একটি নতুন জঙ্গি সংগঠন ব্যাপকভাবে তৎপর থাকার তথ্য বেরিয়ে আসে। জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যরা পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে চুক্তি করে গহিন জঙ্গলে ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। পাহাড়ে অভিযানকালে সংগঠন দুটির হামলায় এক সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। আহত হন দুই সেনা সদস্য।র্ যাব ও পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গি সংগঠনটির শীর্ষ নেতাসহ ৮২ জন গ্রেপ্তার হয়। কেএনএফের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাসহ গ্রেপ্তার হয় ১৭ জন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে জঙ্গি সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে। উলেস্নখ্য, এর আগে বিভিন্ন সময় জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা অব বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ পরে নাম সংক্ষিপ্ত করে হরকাতুল জিহাদ (হুজি), শাহাদাৎ-ই আল-হিকমা, হিযবুত তাহরীর, আনসারুলস্নাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম ও আলস্নাহর দল নামে জঙ্গি সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ সরকার।