নতুন সূচিতে মেট্রোরেল
প্রথম দিনেই উপচেপড়া ভিড়, তবুও খুশি যাত্রীরা
প্রকাশ | ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
বিজয় সরণি স্টেশন থেকে মতিঝিল অভিমুখে পর পর তিনটি মেট্রোরেল ছেড়ে গেলেও উপচেপড়া ভিড়ের কারণে তাতে উঠতে পারেননি সিমলা রানী কোচ। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে প্রচন্ড ভিড় ঠেলে চতুর্থ ট্রেনটির নারী কামরায় উঠেন তিনি। কিন্তু সেখানেও যেন তিল ধারণেই ঠাঁই নেই! কোনোরকম চাপাচাপি করে ৬/৭ মিনিট পরই নামেন মতিঝিল স্টেশনে। টাঙ্গাইলের সা'দত বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী শুক্রবার ঢাকা এসেছিলেন চাকরির পরীক্ষা দিতে। শনিবার থেকে নতুন সূচিতে মেট্রোরেল চলায় বড় বোনকে নিয়ে মেট্রো ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিতে বেরিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, 'মতিঝিল থেকে উত্তরা-উত্তর স্টেশন
হয়ে ফের বিজয় সরণিতে এসে নামব ভেবেছিলাম। কিন্তু মতিঝিল নেমে দেখি কাউন্টারগুলোতে মানুষ আর মানুষ। দাঁড়ানোর জায়গা নেই। তারপরও আধাঘণ্টার মতো টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম লাইন খুব বেশি সরছে না। শেষ পর্যন্ত বাসে চেপে বাসায় ফিরেছি।'
সারাদিন মেট্রোরেল চলবে এবং ছুটির দিনে ভিড় কম থাকবে- এমনটি ভেবে স্ত্রী নূরজাহানকে নিয়ে গাজীপুর থেকে মেট্রোরেলে চড়ার অভিজ্ঞতা নিতে এসেছিলেন আব্দুর রহিম (৬৫)। তিনি জানান, ১১টার দিকে উত্তরা স্টেশন থেকে মেট্রোরেলে চড়েছেন। এখানে টিকিট পেতে কিছু সময় বিলম্ব হলেও তেমন দেরি হয়নি। কিন্তু মতিঝিল স্টেশনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও টিকিট না পেয়ে অবশেষে ফিরে যাচ্ছেন। তিনিও বাসে করে বাড়ি ফিরে যাবেন।
নতুন সময়সূচিতে যাত্রা শুরু করেছে মেট্রোরেল। আর তাই শনিবার সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় শুধু রাজধানীরই নয়, ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে মেট্রোরেলে ভ্রমণ করতে বেরিয়েছিলেন।
আগেই জানানো হয়েছিল মেট্রোরেল শনিবার থেকে পুরো সময় মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত চলবে।
মেট্রোরেলের সারা দিনের এই যাত্রায় শনিবার সকাল থেকেই যাত্রীর উপচেপড়া ভিড় ছিল। প্রতিটি বগি ছিল যাত্রীতে একেবারে পূর্ণ।
শনিবার বেলা একটার দিকে মতিঝিল স্টেশনে টিকিট কাউন্টারে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। এক ঘণ্টা কিংবা তারও বেশি সময় লাইনে দাঁড়িয়ে তবেই মিলেছে কাঙ্ক্ষিত টিকিট। কাউন্টারে যারা টিকিট দিচ্ছিলেন তাদের যেমন যাত্রীদের টিকিট দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে তেমনি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা কর্মীদেরও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। তবে সারা দিন মেট্রোরেল চালু হওয়ায় খুশি যাত্রীরা। কারণ অল্প সময়ে কাজ শেষে গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন তারা। তবে যেসব যাত্রী বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তাদের অনেকেই এদিন মেট্রোরেলে মতিঝিল এলেও ফিরেছেন বাসে।
মতিঝিল স্টেশনের মতো যাত্রীর ভিড় ছিল উত্তরা স্টেশনে। পথের অন্য স্টেশনেও কমবেশি ভিড় দেখা গেছে। তবে এসব স্টেশনে যাত্রীদের লাইনে দাঁড়াতে হয়নি।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, শনিবার সকাল ৭টা ১০ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিলের উদ্দেশে প্রথম ট্রেন ছাড়ে। যাদের এমআরটি পাস ও র?্যাপিড পাস ছিল তারা সব স্টেশন থেকে সকালে স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করতে পেরেছেন। এ ছাড়া মতিঝিল স্টেশন থেকে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে প্রথম ট্রেন উত্তরার উদ্দেশে ছাড়ে। নতুন সময়সূচি অনুযায়ী, উত্তরা-মতিঝিল অংশে সকাল ৭টা ১০ মিনিট থেকে রাত ৮টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত চলবে নগরজীবনে স্বস্তি আনা মেট্রোরেলে এই পরিষেবা।
কর্তৃপক্ষ জানায়, সকাল ৭টা ১০ থেকে সাড়ে ১১টা এবং বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মেট্রোরেলে পিক আওয়ার ধরা হচ্ছে। মাঝে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত অফ পিক আওয়ার। পিক আওয়ারে ১০ মিনিট পরপর ট্রেন স্টেশনে আসবে। অফ পিক আওয়ারে ট্রেন স্টেশনে আসবে ১২ মিনিট পর পর।
মেট্রোরেল মুছে দিয়েছে অনেকের ভোগান্তি
কাপড় ব্যবসায়ী টিটু মিয়া ২৫ বছর ধরে মিরপুর থেকে গুলিস্তানে আসা-যাওয়া করছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে যানজট আর যাতায়াতের ভোগান্তি। আসা-যাওয়া মিলিয়ে চার ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যাচ্ছিল। তার 'অসহ্যকর' চার ঘণ্টার ওই পথ কমে দাঁড়িয়েছে ২২ মিনিট করে ৪৪ মিনিট।
শনিবার সকালে টিটু মিয়া মিরপুর থেকে গুলিস্তানে যেতে চড়ে বসেন মেট্রোরেলে। আর মাত্র ২২ মিনিটে সচিবালয় স্টেশনে নেমে পৌঁছে যান তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এখন থেকে রাতে ফিরতেও ট্রেন পারবে।
তিনি জানান, 'অনেক দিন এমনও হয়েছে যে রাতে বাসায় যাওয়ার জন্য বাসে উঠে মৎস্য ভবনের সামনের সিগন্যালেই আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বসে আছি। অনেক সময় জেদ করে সেই মৎস্য ভবন মোড় থেকে হেঁটেই মিরপুর চলে গেছি।'
টিটু বলেন, 'সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেট্রো চলবে শুনে কি যে আনন্দ লাগছে তা বলে বুঝাতে পারব না। মনে হলো আমি আরও কিছু দিন বেশি বাঁচব। আর এখন মাত্র ২২ মিনিটে মিরপুর থেকে গুলিস্তানে পৌঁছাব, এটা আমার কাছে বিরাট আনন্দের।'
ঢাকার মিরপুর থেকে হাইকোর্টে ওকালতি করা ইব্রাহিম খলিল বলেন, 'যানজটের কারণে সময়মতো আদালতে পৌঁছাতে পারতাম না অনেক সময়। কোর্ট ধরার জন্য সকাল ৭টায়ও বাসে উঠতে হয়েছে। রাতে ঘুমও ভালো হতো না পথের টেনশনে। তবে গত কয়েক মাস ধরে সকালের মেট্রো ধরে কোর্টে আসতে পারলেও বিকালে যাওয়ার সময় বিড়ম্বনায় পড়েছি। কীভাবে বাসায় ফিরব তা নিয়ে টেনশনে থাকতাম। এখন থেকে ট্রেনে চড়ে নিরাপদে বাসায় যেতে পারব এতে আমার অনেক নির্ভার লাগছে।'
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দিনে ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫৬ হাজার যাত্রী মেট্রোতে ভ্রমণ করছেন। এর আগে, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত মেট্রোরেল চলত। আর উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলাচল করছিল মেট্রোরেল।
প্রকাশক-লেখকদের দাবি বাড়তি সময়ের
এদিকে ফেব্রম্নয়ারিতে শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। প্রকাশক-লেখকদের দাবি, বইমেলা চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে মেট্রোরেল রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত থামুক। এ বিষয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'এই সময় বৃদ্ধি করার কথা ছিল মার্চে। তার আগেই আমরা সেটা করলাম। তারপরও আমরা দেখব। যদি দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময়ের পরও রাতে যাত্রী থাকছে তখন আমরা চিন্তা করব।'
সবশেষ মেট্রোরেলের শাহবাগ ও কারওয়ান বাজার স্টেশন চালু হয় ৩১ ডিসেম্বর। এর মাধ্যমে এমআরটি-৬ লাইনের দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬ স্টেশনই চালু হয়। প্রতিটি স্টেশনের জন্য আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করা রয়েছে। মেট্রোরেলে চলাচলের সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। আর উত্তরা থেকে মতিঝিল স্টেশন পর্যন্ত ভ্রমণে সর্বোচ্চ ভাড়া ১০০ টাকা। উত্তরা থেকে বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভাড়া ৯০ টাকা। উত্তরা থেকে ফার্মগেটের ভাড়া ৭০ টাকা। অন্যদিকে আগে চালু হওয়া উত্তরা নর্থ স্টেশন (দিয়াবাড়ী) থেকে আগারগাঁও স্টেশনের ভাড়া ৬০ টাকা। মাঝের সাতটি স্টেশনের জন্য আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করা রয়েছে।