দেশীয় অস্ত্রসহ ২ জন গ্রেপ্তার
রাজধানীতে সক্রিয় 'থাপ্পড় দিয়ে' ছিনতাইকারী চক্র
প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
রাজধানী ঢাকায় সক্রিয় হয়ে উঠছে 'থাপ্পড় দিয়ে' পথচারীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়া ছিনতাইকারী চক্র। তারা ছিনতাই করতে বাধা পেলে কাউকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। চক্রের সদস্যরা আচমকা টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে থাপ্পড় মারতে থাকে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই ব্যক্তির সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা চক্রের অন্য সদস্যরা কেড়ে নিয়ে সবাই দ্রম্নত পালিয়ে যায়। চক্রের দুই সদস্য হাতেনাতে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য।
ঢাকা মহানগর পুলিশ জানায়, গত ১৩ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে থেকে ছিনতাইকালে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পারভেজ (২৭) ও জীবন (২৪) ওই দুই ছিনতাইকারীর কাছে ২টি ধারালো আধুনিক ছুরিও পাওয়া গেছে। 'সুইচ গিয়ার' নামে ছুরিগুলো ভাঁজ করে অনায়াসে সব সময়ই বহন করা যায়। পরে তাদের তেজগাঁও থানা হেফাজতে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন যায়যায়দিনকে এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, গ্রেপ্তাররা পেশাদার ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য। ছিনতাইয়ে বাধা দিলে তারা প্রয়োজনে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনা ঘটাতেও দ্বিধা করে না। বাধাদানকারীকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করা তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার। তারা নেশার ঘোরে ছিনতাই করে। আবার ছিনতাই করা টাকা দিয়েও নেশা করে। ইয়াবা ও হেরোইনে আসক্ত তারা। মাদক সেবন ও বিক্রির সঙ্গেও জড়িত তারা।
ওসি আরও জানান, গত বছরের জুলাইতে ফার্মগেটে ছিনতাইকারীদের হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ১
ছুরিকাঘাতে নিহত হন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কনস্টেবল মনিরুজ্জামান। ঘটনার সময় পুলিশ সদস্য সাদা পোশাকে ছিলেন। ছুটি শেষে গ্রামের বাড়ি থেকে বাসযোগে ফিরে ফার্মগেটে নেমেছিলেন। তখনই ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্রের মুখে তার সঙ্গে থাকা টাকা ও ব্যাগ ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। বাধা দিলে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা।
এদিকে এ ঘটনায় গত বছরের ৩ জুলাই আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে হত্যাকান্ডে জড়িত ছিনতাইকারী চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করার কথা জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ডক্টর খন্দকার মহিদ উদ্দিন।
ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলছেন, পুলিশ হত্যায় যে ছিনতাইকারী চক্রটি জড়িত, সদ্য গ্রেপ্তার হওয়া দুই ছিনতাইকারী ওই চক্রের সদস্য হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিষয়টি এখনো শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিষয়টি জানতে পুলিশ ও গোয়েন্দারাও কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তারদের জড়িত থাকা বিচিত্র কিছুই না। কারণ তারা ফার্মগেট এলাকাকেন্দ্রিক পুরনো ছিনতাইকারী চক্রের পেশাদার সদস্য। পুলিশ হত্যার বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও গ্রেপ্তার দুই ছিনতাইকারী ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করেছে। চক্রটির অপর সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। গ্রেপ্তার দু'জন এতটাই পেশাদার ছিনতাইকারী যে, তাদের হাতেনাতে না ধরতে পারলে, তাদের আর হদিসই পাওয়া যেত না। কারণ তারা ঘুরে ঘুরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই করে। এজন্য ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করা একটি জটিল কাজ।
ওসি মোহাম্মদ মহসীন আরও জানান, পুরো ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় যারা ছিনতাইয়ে জড়িত, তারা মোটামুটি প্রত্যেক এলাকা সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে। কে কোন এলাকায় ছিনতাই করে তাও নির্দিষ্ট করা। ছিনতাইকারীরা গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশল পাল্টায়। এক এলাকার ছিনতাইকারী অনেক দূরের এলাকায় গিয়ে ছিনতাই করে। এতে তাদের শনাক্ত করা যায় না। আবার অনেক এলাকায় বড় ধরনের ছিনতাই করার পর ছিনতাইকারীরা নিভৃত গ্রামে চলে যায়। মোটা অঙ্কের টাকার ক্ষেত্রে ছিনতাইকারীরা এমন কৌশল নেয়। তবে যে এলাকায় ছিনতাই হোক না কেন, ওই এলাকার ছিনতাইকারী দলের প্রধান ছিনতাইকৃত মালামালের ভাগের একটি অংশ পায়।
ওসি মোহাম্মদ মহসীন জানান, গ্রেপ্তার পারভেজের বিরুদ্ধে ৭টি ও জীবনের বিরুদ্ধে ৬টি ছিনতাই মামলা আছে। তাদের কাছে সব সময়ই ধারালো আধুনিক চাকু থাকত। অধিকাংশ চাকুই সুইচ গিয়ার ধরনের। এ ধরনের চাকু ভাঁজ করে অনায়াসে শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় বহন করা সম্ভব। তারা সুযোগ পেলেই ছিনতাই করত। আর শীতের মধ্যে সুবিধা বেশি। মুখ, মাথা ঢেকে ছিনতাই করে। শীতের কারণে মানুষ সন্দেহ করে না। গরমের সময় মুখ মাথা ঢাকলে মানুষের মধ্যে সন্দেহ হয়। এজন্য গরমের সময় তারা রাতে আর শীতের সময় তারা রাত-দিন নেই, সুযোগ পেলেই ছিনতাই করত।
ওসি বলছেন, তাদের ছিনতাইয়ের ধরনটিই অভিনব। টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে যদি কিছুটা নিরিবিলি জায়গায় পায়, তখনই ছিনতাইকারী চক্রটি সোজা তার সামনে গিয়ে হাজির হয়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই-তিনজন ছিনতাইকারী টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে একাধারে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে। এতে আশপাশে থাকা মানুষের মধ্যে মার খাওয়া ব্যক্তিটি কোনো অন্যায় করেছে বলে ধারণা করে।
এদিকে চলতে থাকে চড়-থাপ্পড়, আরেক দিকে ওই ব্যক্তির সঙ্গে থাকা মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন ও পকেট তলস্নাশি করে টাকা-পয়সা নিয়ে মুহূর্তেই পালিয়ে যায়। ছিনতাই করার সময় তারা এমন একটি ভাব করে, মনে হয় তারা এলাকার বিশাল কোনো হোমড়া-চোমড়া লোক। সম্প্রতি ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বসুন্ধরা শপিংমলসহ আশপাশের এলাকায় এ ধরনের ছিনতাইকারীদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এজন্য নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। ঢাকায় এমন বেশ কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্র আছে। চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারে কাজ চলছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের বরাত দিয়ে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, ছিনতাই খুবই আতঙ্কের বিষয়। একমাত্র যারা ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছেন, তারাই বুঝতে পারবেন ছিনতাইকারীরা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে অনেককেই চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে।
ডিসি ফারুক হোসেন আরও বলেন, ডিএমপি কমিশনার ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারে ডিএমপির সব ইউনিটকে কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। বিশেষ করে সব ক্রাইম জোনের পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) ও থানা পুলিশকে ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাতে নির্দেশনা দিয়েছেন। ডিএমপি কমিশনার ঢাকাবাসীকে ছিনতাইকারী মুক্ত ঢাকা উপহার দেওয়ার চেষ্টা করছেন।