ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারে অভিযান শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। অভিযানে ট্রেড লাইসেন্স না থাকা, বেশি দামে চাল বিক্রি ও মূল্যতালিকা না থাকাসহ সুনির্দিষ্ট নানা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের শুধু সতর্ক করেই বাজার তদারকি শেষ করে চলে যান। আর অভিযানের খবর পেলেই দোকান খোলা রেখে সটকে পড়েন ব্যবসায়ীরা। এমন প্রেক্ষাপটে বিক্রেতারা বলছেন, যেখানে অভিযান চালালে দাম কমবে সেখানে না গিয়ে খুচরা পর্যায়ে অভিযান চালানো আইওয়াশ ছাড়া কিছুই নয়।
জানা গেছে, আমন মৌসুমের ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে ডিসেম্বরের শুরুতেই। বাজারে সরবরাহও আছে স্বাভাবিক। তবু চালের দামে এর প্রভাব নেই। উল্টো দুই সপ্তাহ ধরে মোকাম, পাইকারি ও খুচরা বাজারে দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে বিভিন্ন পর্যায়ে চালের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত। অথচ এবার সর্বোচ্চ ধান উৎপাদনের কথা জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। অভিযোগ উঠছে, মুনাফা বাড়ানোর প্রবণতা থেকে মিল পর্যায়েই কৃষকদের থেকে কম দামে কেনা চালের মূল্য বাড়ানো হচ্ছে।
আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিতে ক্রেতারা বিস্ময় ও ক্ষোভের পাশাপাশি অসহায়ত্বের কথা বলছেন, আর বিক্রি-বাট্টা কমে যাওয়ার কথা জানাচ্ছেন খুচরা দোকানিরা। তারা অসময়ে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য চালকল মালিকদের দুষছেন। অন্যদিকে চালকল মালিকরা বাজারে ধানের সরবরাহ কমে যাওয়া এবং দাম বেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন। এ পরিস্থিতিতে চালের বাজার তদারকি করতে ঢাকায় চারটি গোপন অভিযানকারী দল নামানোর ঘোষণা দেয় খাদ্য অধিদপ্তর।
শুক্রবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটের দিকে রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজারে তদারকিতে আসে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কুল প্রদীপ চাকমার নেতৃত্বে একটি টিম। সেখানে ১১টা ৩৯ মিনিট পর্যন্ত অবস্থান করেন তারা।
এ সময় দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রথমেই মেসার্স জাকির ট্রেডার্স নামে প্রতিষ্ঠানে যান। তারা প্রতিষ্ঠানটির টাঙানো তালিকার সঙ্গে চালের নমুনার মিল আছে কি না সেটি খতিয়ে দেখেন। সব নমুনা চালের মধ্যে নাম ও দাম সংবলিত কাগজ লাগানোর নির্দেশ দেন কর্মকর্তারা। এরপর পর্যায়ক্রমে মেসার্স সেলিম রাইস ভান্ডার, ইয়াসিন ট্রেডার্স, ফিরোজ ট্রেডার্স, মানিক স্টোরসহ কয়েকটি খুচরা চালের দোকান পরিদর্শন করেন তারা।
বেশকিছু দোকানে লাইসেন্স, মূল্যতালিকা পাওয়া যায়নি। এমনকি কিছু দোকানে অতিরিক্ত দামে চাল বিক্রি করতেও দেখা যায়। তবে ৩০ মিনিটের এই অভিযানে মৌখিক সতর্কতা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি টিম।
এর আগে মদিনা রাইস এজেন্সি নামক চালের দোকানে গিয়ে চালের মূল্য জানতে চান কর্মকর্তারা। এ সময় প্রতি কেজি আটাশ চালের দাম জানতে চান কর্মকর্তারা। ক্রেতা মনির জানান, এক জাতের আটাশ ৫১ টাকা যা কেনা পড়েছে ৪৮ টাকায় এবং অন্য জাতের আটাশ চাল ৫৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে, যা ৫১ টাকায় কেনা।
তখন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিক্রেতাকে জানান, পাইকারি বাজারে কেনাদামের চেয়ে ২ টাকা বেশিতে চাল বিক্রি করা যাবে। এর বেশি বিক্রি করা অন্যায়। পরে বিক্রেতা পরিবহণ খরচ এবং আড়তে কমিশন দেওয়ার কথা জানান।
এ সময় কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক চালের দাম কেজিতে ২ টাকা লাভ রেখে বাকিটা কমানোর নির্দেশ দেন। আড়তটির একজন কর্মচারী সঙ্গে সঙ্গে তালিকাটি সংশোধন করেন।
অভিযান প্রসঙ্গে মানিক স্টোরের মালিক বলেন, আমরা ছোট ব্যবসায়ী, আমাদের লাইসেন্স, বাজার দর দেখে তো কোনো লাভ নেই। আমাদের কাছে দেখতে এলে আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু বড় বড় মিল মালিক ও চালের আড়ত এগুলোতে যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে কোনোভাবেই চালের দাম কমবে না। বরং বাড়তেই থাকবে।
রফিক মিয়া নামে আরেক বিক্রেতা বলেন, এখন তো বাজারে নতুন চাল আসছে, সে প্রেক্ষিতে বাজারে বরং চালের দাম কমার কথা, কিন্তু উল্টো ৭-৮ টাকা বেড়ে গেছে। এটা সিন্ডিকেটের কারসাজি। যখন দেখল নির্বাচন চলে গেছে, নতুন করে মন্ত্রীরা এখনো ওইভাবে কাজ শুরু করেনি, এই সুযোগে তারা দামটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা সারাদিনে চাল বিক্রি করি ২-৪ বস্তা, এখানে অভিযান চালিয়ে লাভ কী? দাম কমাতে চাইলে যেতে হবে গোড়ায়। বড় বড় কোম্পানিকে চাপ দিয়ে দাম কমালে আমরা এমনিতেই কম দামে বিক্রি করব।
এদিন কারওয়ান বাজারেও চালের দোকানে তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। অভিযানের কথা শুনেই অনেক ব্যবসায়ী দোকান থেকে সটকে পড়েন। অবশ্য অন্যরা দাবি করেন, দোকানদাররা সকালের নাস্তা করতে গেছেন।
বাজার তদারকি প্রসঙ্গে উপসচিব কুল প্রদীপ চাকমা বলেন, খাদ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে তারা প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন যে, চার দিনের মধ্যে চালের দাম কমাবেন। আজকে (শুক্রবার) দ্বিতীয় দিন। আমরা এখন বাজার ঘুরে তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আরও দুই দিন এই তদারকি চলবে।'
কুল প্রদীপ চাকমা বলেন, আমরা দেখেছি কয়েকটি দোকানে নামভেদে চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে, আবার যারা বস্তা কিনছেন, তাদের থেকে ৩ থেকে ৪ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে। সব মিলিয়ে চালের বাজারে আমরা একটা অসামঞ্জস্যতা পেয়েছি। আমরা তাদের নতুন করে চালের দাম লিখে দিতেও বলেছি।
তিনি বলেন, আমাদের আজকের (শুক্রবার) মনিটরিং ছিল শুধু সচেতন করার জন্যই। এরপরও যদি তারা ঠিক না হয় তাহলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি কোনো ভোক্তা অতিরিক্ত দামে চাল কিনে, এক্ষেত্রে সে চাইলে ভোক্তা অধিদপ্তরে মামলা করতে পারে। এমনকি ভ্রাম্যমাণ টিমকে যদি কোনো ভোক্তা অভিযোগ জানায় তাহলে তারা ব্যবস্থা নেবে।
উপসচিব বলেন, সেদিনের বৈঠকেই খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন যে, আমরা কাউকে অসম্মান করতে চাই না। ব্যবসায়ীরা সম্মানিত মানুষ। রাষ্ট্রে তাদেরও অংশগ্রহণ রয়েছে। সব মিলিয়ে দৈনিক ভোগ্যপণ্যের বাজারে দাম বাড়ার কারণে মানুষের ওপর যেন চাপ না পড়ে, সেটি সরকার এবং আমাদের মন্ত্রণালয় সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমনকি দেশের অন্যান্য বিভাগ এবং জেলা পর্যায়েও এই কার্যক্রম চলছে।
তিনি আরও বলেন, চালের বাজারে খুচরা ব্যবসায়ীরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা আড়তদারদের দোষারোপ করছেন। এ বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখব।
নির্বাচনের সময় তদারকি কম হওয়ার কারণে সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছেন- এমন কথার সত্যতা আছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে কুল প্রদীপ চাকমা বলেন, এই মোটিভ আমরা বলতে পারব না, তবে স্পষ্ট করে একটি কথা বলতে চাই- আমরা যে খাদ্য আইন প্রণয়ন করেছি, সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়ম করলে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কেউ যদি পাইকারি পর্যায়ে এই দাম বাড়ানোর চেষ্টা করেন, তাহলে তার সাজা হবে। আমরা বারবার বলতে চাচ্ছি, কাউকেই আমরা অসম্মান করতে চাই না। এটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য সবার সহযোগিতা দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাজারে মনিটরিং শেষে খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্তি পরিচালক সেলিমুল আজাম উপস্থিত সংবাদিকদের বলেন, আমরা গত ১৫ জানুয়ারি থেকে বাজার মনিটরিংয়ে নেমেছি। এরপর থেকে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থার দিকে যাচ্ছে বলে আমাদের ধারণা। গত ১৬ তারিখে আমরা আমরা বাবু বাজারে অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। সেখানে কেজি প্রতি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৭০ টাকা। আজ (শুক্রবার) কারওয়ান বাজারে আমরা ৬৬-৬৭ টাকা দেখেছি। এতে চালের বাজার নিম্নমুখী বলে আমরা মনে করছি।
প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিন প্রায় সব বাজারেই যাচ্ছি এবং মনিটরিং করছি। এখন আমাদের অভিযান মোটিভেশন পর্যায়ে আছে। আমরা খুচরা ও পাইকারি দোকানদারদের সতর্ক করছি। ধীরে ধীরে আমরা হয়তো আইন প্রয়োগ করব। তখন প্রয়োজনে আমরা জরিমানা বা শাস্তির দিকে যাব।