বৈরী আবহাওয়ার কবলে বিশ্ব

১৪৫ বছরের মধ্যে হিমাঙ্কের নিচে রাশিয়ায় তাপমাত্রা ফিনল্যান্ডে তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

আলতাব হোসেন
শীতকে সঙ্গে নিয়েই বছর শুরু করেছে বাংলাদেশ। শীতে বিপর্যস্ত জনজীবন। প্রবাদ আছে 'মাঘের শীতে বাঘ পালায়'। বাংলা পঞ্জিকা মতে, মাঘের প্রথম সপ্তাহ চলছে। এর মধ্যে শীতে জবুথবু উত্তরের মানুষ। শীতে স্থবির হয়ে পড়েছে দিনাজপুর অঞ্চলের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। দেশের ১০ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ। এ পর্যন্ত দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পঞ্চগড়ে বৃহস্পতিবার ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন খেটে-খাওয়া ও ছিন্নমূল মানুষ। শিশু-বৃদ্ধরা শীতজনিত রোগে ভুগছেন। কৃষিতে বীজতলা হলুদ হয়ে যাওয়া ও রবিশস্যের ক্ষতি হচ্ছে এবং বোরো রোপণ পিছিয়ে যাচ্ছে। কোল্ড ইনজুরিতে মাঠেই ঝরে পড়ছে সরিষার ফুল, শাকসবজি, পেঁয়াজ, ডালসহ অন্যান্য ফসল। ফসলের মাঠে পোকার আক্রমণ বাড়ছে। ফসলের ক্ষতি নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষক। আবহাওয়ার এমন আচরণ শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্বজুড়েই বৈরী আবহাওয়া। ২০২৩ সাল ছিল বিশ্বে ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ গরমের বছর। আর ২০২৪ সাল শুরু হয়েছে রেকর্ড ভাঙা শীত দিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ব্যাকরণ ভুলে বৈরী হয়ে ওঠছে আবহাওয়া। ২০২৩ সালে ইউরোপ থেকে আমেরিকা তীব্র দাবানল, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রেকর্ড ভাঙ্গা তাপদাহে বিপর্যস্ত হয়। এশিয়ার দেশগুলোতে খরায় পুড়ে ফসলের মাঠ। ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্র রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরমের সেই ভোগান্তি যেতে না যেতেই তীব্র শীতে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। তাপদাহের পর এবার শীতও রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান ও নৌপরিবহণ চলাচলে বিঘ্ন হচ্ছে। বুধবার হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরগামী আন্তর্জাতিক চারটি ফ্লাইট ভারতের হায়দরাবাদ ও কলকাতায় অবতরণ করে। এ ছাড়া ১০টি ফ্লাইটের সিডিউল বিপর্যয় ঘটে। রিয়াদ থেকে আসা সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের রাত ২-১০ মিনিটে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের কথা ছিল। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে নামতে না পেরে সেটি অবতরণ করে ভারতের হায়দরাবাদে। একই কারণে রাত ৪টার পর দুবাই, মাসকাট ও কুয়ালালামপুর থেকে আসা আরও তিনটি ফ্লাইট অবতরণ করে ভারতের কলকাতার নেতাজি সুভাস চন্দ্র বিমানবন্দরে। এ ছাড়াও শাহজালাল বিমানবন্দরগামী ১০টির বেশি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের সিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কুয়ালালামপুর, গুয়াংজু, দুবাই, শারজাহ, দোহা, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, মাসকাট ও কুয়েত সিটি থেকে আসা এসব ফ্লাইট ১-৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে অবতরণ করেছে। বুধবার দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ঘন কুয়াশার কারণে রাত ১টা থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে কুয়াশার পরিমাণ কেটে গেলে সকাল ১০টার পর ফেরি চলাচল আবারও শুরু হয়। শীত আর ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে চারপাশ। কনকনে শীতে কাঁপছে রংপুর, কুড়িগ্রাম, রাজবাড়ী, পঞ্চগড়, পাবনা, নীলফামারী, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গার জনজীবন। দেশের ১০ জেলায় শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়ার ভাষায়, সাধারণত তাপমাত্রা যদি আট থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তবে সেটাকে ধরা হয় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। তাপমাত্রা এর চেয়ে কমে ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামলে হয় মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ আর চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়। এদিকে, ঘন কুয়াশা ও তীব্র ঠান্ডায় মুখোমুখি ভারতের উত্তরাঞ্চল। দেশটির রাজধানী দিলিস্নতে তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রিতে নেমেছে। কয়েকটি রাজ্যে জারি করা হয়েছে রেড এলার্ট। কনকনে শীতে কাঁপছে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা। জারি করা হয়েছে শৈত্যপ্রবাহের সতর্কতা। ঘন কুয়াশার কারণেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে দক্ষিণবঙ্গসহ উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জেলায়। শীত আর শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়েছে চীন। এক সপ্তাহ ধরে রাজধানী বেইজিংয়ে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শূন্যের নিচে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ১৯৫১ সালের পর শহরটিতে এত ঠান্ডা পড়েনি। উত্তর ও উত্তর-পূর্ব চীনের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। সেখানে কিছু জায়গায় তাপমাত্রা মাইনাস ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছে। চীনের আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, এবার রেকর্ড ঠান্ডা পড়েছে। এর আগে এত শীত দেখেনি চীন। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হেনেছে শীতকালীন ঝড়। দেশটির বড় অংশজুড়ে শীত ও ভারী তুষারপাতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শীত পরিস্থিতিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে 'জীবনহরণকারী মাত্রার মারাত্মক শীত' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সেখানে হাজার হাজার বাড়িঘর বিদু্যৎহীন হয়ে পড়েছে, চলতি সপ্তাহে দুই হাজারের বেশি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। প্রায় সাত হাজার ফ্লাইট বিলম্বিত হয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যে শীতলতার মাত্রা রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছে। হাঁড় কাঁপানো শীতে যুক্তরাষ্ট্রে দুইজনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। হাঁড় কাঁপানো শীত, তুষারপাতে বিপর্যস্ত ইউরোপের বিভিন্ন এলাকা। জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং রাশিয়াসহ ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে দেখা দিয়েছে তীব্র তুষারপাত। কঠিন পরিস্থিতিতে রাশিয়া। ১৪৫ বছরের মধ্যে ভারী তুষারপাতের কবলে মস্কো। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা গ্রাস করেছে পুরো রাশিয়াকে। রেকর্ড তুষারপাতে ভুগছে মস্কো। এ ছাড়াও কানাডা, মঙ্গোলিয়া, স্কটল্যান্ড, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শীত ও তুষারপাত বেড়েছে। সুইডেনে গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালের পর সুইডেনে জানুয়ারিতে এটিই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। সুইডেনে গত কয়েকদিনে তাপমাত্রা এতই কমেছে যে, সেখানে অনেক জায়গায় বাস পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উমেরা শহরে গত কয়েকদিন ধরে ট্রেনের যাত্রাও বাতিল করা হয়েছে। চলতি শীত মৌসুমে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি শীতের তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ফিনল্যান্ড। গত সপ্তাহে তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়। শৈত্যপ্রবাহের কারণে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে নরওয়ের দক্ষিণে একটি প্রধান মহাসড়ক বন্ধ রাখা এবং ফেরি লাইনের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। তুষারপাত, বরফ আর হাঁড় কাঁপানো বাতাসে বিপর্যস্ত ইউরোপের বিভিন্ন এলাকা। তীব্র শীতে বিপর্যস্ত জার্মানির জনজীবন। সপ্তাহব্যাপী এই বৈরী আবহাওয়ায় অচল হয়ে পড়েছে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল। সাইবেরিয়ায় তাপমাত্রা এরই মধ্যেই পৌঁছেছে মাইনাস ৫৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। স্কটল্যান্ডের উত্তর-পূর্বের ১২টি স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হলুদ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। তথ্য সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন, আলজাজিরা, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও ইউরো নিউজ