ঢাকার বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা ইকরামুল হক। তিনি পেশায় একজন সিএনজি অটোরিকশা চালক। ফলে রুটি-রুজির প্রয়োজনে প্রতিদিন ভোরেই তাকে ঘর ছেড়ে বের হতে হয়। এবারের শীতে হাড়ে পর্যন্ত কাঁপন ধরে যাচ্ছে মন্তব্য করে ইকরামুল বলেন, 'ঢাকাতে এমন শীত এর আগে আমি দেখছি বলে মনে পড়ে না। শীতের কারণে আমাদের আয়-ইনকামও কমে গেছে। এত শীতের মধ্যে মানুষ কাজ ছাড়া বের হতে চায় না।' ইকরামুলের মতো অনেকের মুখেই শোনা যাচ্ছে যে, এ বছর শীত বেশি পড়ছে। কেউ কেউ একে 'অস্বাভাবিক'ও বলছেন।
কিন্তু আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ভিন্ন কথা। প্রতিষ্ঠানটির হিসেবে দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শীত পড়েছে ২০১৮ সালে। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নেমেছিল দুই দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড। সে বছর সারাদেশে দফায় দফায় তীব্র শৈত্যপ্রবাহও দেখা গিয়েছিল। সেখানে এ বছর এখন পর্যন্ত কোনো জেলাতেই তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়নি বলে জানাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
কিন্তু এরপরও মানুষ কেন 'অস্বাভাবিক' শীতের কথা বলছে? এই প্রশ্নের জবাবে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, খাতা-কলমে তাপমাত্রা খুব একটা না কমলেও বেশ কিছু কারণে এবার শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। পুরো জানুয়ারি মাসজুড়েই শীতের এমন অনুভূতি থাকতে পারে বলেও জানিয়েছেন তারা।
দীর্ঘ সময়ের কুয়াশা : এদিকে, যেসব কারণে বাংলাদেশে এ বছর শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে, সেগুলোর একটি হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে কুয়াশা পড়া। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার দীর্ঘ সময় ধরে ঘন কুয়াশা পড়তে দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও ১৮-২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কুয়াশা
থাকছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়াবিদ ডক্টর মুহাম্মদ আবুল কালাম মলিস্নক জানান, 'এবার কুয়াশা তৈরির প্রবণতা একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। আর এই দীর্ঘ সময়ের কুয়াশার কারণে সূর্যের কিরণকাল কমে এসেছে। অর্থাৎ সূর্য বেশিক্ষণ আলো দিতে পারছে না। তিনি বলেন, 'স্বাভাবিক সময় সূর্যের কিরণকাল ৮-১২ ঘণ্টা হলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে তিন থেকে চার ঘণ্টায়। এতে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হতে না পারায় দিনের ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেকটাই কমে গেছে। ফলে শীতও বেশি অনুভূত হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এ বছর দিনের তাপমাত্রা দুই থেকে সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমতে দেখা গেছে। বিশেষ করে ১১ জানুয়ারির পর থেকে এটি বেশ কমে এসেছে। বস্তুত কোনো অঞ্চলের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য যদি ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে আসে, সেখানে শীতের অনুভূতি বাড়তে থাকে। আর পার্থক্য যদি পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসে, তাহলে সেখানে শীতের অনুভূতি প্রকট থেকে প্রকটতর হয়। অর্থাৎ হাড় কাঁপানো শীত অনুভূত হয়।'
এদিকে, গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন জেলার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার তুলনা করে দেখা গেছে, রংপুর, দিনাজপুর, তেতুলিয়ার মতো উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ অঞ্চলেই তাপমাত্রার পার্থক্য পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম। এ ছাড়া ঢাকা, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম দেখা গেছে।
হঠাৎ কুয়াশা বাড়ছে কেন? : বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে সম্প্রতি বেশ কয়েকবারই ঢাকাকে শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকায় দেখা গেছে। যানবাহন, ইটভাটা ও শিল্প-কারখানার দূষিত ধোঁয়ার পাশাপাশি নির্মাণকাজের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানান কারণে সারাদেশেই আগের চেয়ে বায়ুদূষণ বেড়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে।
এর মধ্যেই আবার জানুয়ারি মাসে দিলিস্নসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে দূষিত বায়ু প্রবেশের পরিমাণ বেড়েছে বলে জানাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়াবিদ ডক্টর মলিস্নক জানান, 'দূষিত এই বাতাসে প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা মিশে রয়েছে, যা মেঘ ও কুয়াশা তৈরিতে নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখছে।'
গত দুই সপ্তাহে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেটের বেশি কিছু এলাকায় বিকাল পর্যন্ত কুয়াশা দেখা গেছে। এ ছাড়া কোথাও কোথাও কুয়াশা বেশি থাকায় সারা দিন একবারও সূর্যের মুখ দেখা যায়নি বলে জানা গেছে।
হিমালয়ের বাতাস : পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশজুড়ে উচ্চচাপ বলয় তথা বাতাসের চাপ বেশি থাকার কারণে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে শীতের ঠান্ডা বাতাস উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করায় শীতের অনুভূতি তীব্র হচ্ছে বলে জানান আবহাওয়াবিদ ডক্টর মলিস্নক।
তিনি বলেন, 'বাতাসের গতিবেগ তুলনামূলকভাবে একটু বেশি থাকার কারণে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং ঢাকার পশ্চিমাঞ্চল ও খুলনার ওপরের দিকে যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা- এসব অঞ্চলে শীতের অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এ ছাড়াও ঊর্ধ্ব আকাশের বাতাস খুব ঠান্ডা হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে 'জেড স্ট্রিম' বা প্রচন্ড গতিবেগসম্পন্ন বাতাস কখনো নিচে নেমে আসছে, কখনো উপরে উঠে যাচ্ছে। এর ফলে শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে।'
ঘন কুশায়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি : এদিকে, বায়ুদূষণের কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার সারাদেশেই বেশি কুয়াশা দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ধূলিকণাময় এই কুয়াশা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকলে নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিক্ষক ডা. শাহনূর শরমিন।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে এখন আমরা আগের চেয়ে বেশি ফুসফুসের সমস্যা ও এলার্জিজনিত রোগ দেখতে পাচ্ছি। কুয়াশায় মিশে থাকা ধূলিকণা এসব রোগীদের শ্বাসযন্ত্রে ঢুকলে জটিলতা আরও বাড়তে পারে। এ ছাড়া যাদের শ্বাসকষ্ট বা এলার্জিজনিত রোগ নেই, ধূলিকণা-সমৃদ্ধ কুয়াশা শরীরে ঢুকলে তারাও এসব রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।' তিনি আরও বলেন, 'সে জন্য কুয়াশার মধ্যে বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরে বের হতে হবে।'
পাশাপাশি শিশুদের ক্ষেত্রে একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'গরম কাপড় পরানোর পাশাপাশি শিশুদেরও মাস্ক পরাতে হবে। তবে তাদের কুয়াশার মধ্যে বাইরে বের না হতে দেওয়াটাই উত্তম।'
এদিকে, এমনিতেই গত কয়েকদিন ধরে শীত বেশ জেঁকে বসেছে। এর মধ্যে আবার শুরু হতে পারে বৃষ্টি। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আগামী কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন জেলায় আকাশ আংশিক মেঘলা থাকতে পারে। শুক্রবার নাগাদ ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগে অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়ার সঙ্গে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে এই সময় তাপমাত্রা আরও কমে আসতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া রাতে সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে, যা কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তাপমাত্রা আট থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটিকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
এ ছাড়া ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ এবং চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে সেটিকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। আর তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে হয় অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ।
চুয়াডাঙ্গা, কিশোরগঞ্জ, ঈশ্বরদীসহ অল্প কয়েকটি জেলায় এ বছর মৃদু শৈত্যপ্রবাহ দেখা গেলেও সেটি তীব্র আকার ধারণ করেনি। তবে জানুয়ারির শেষের দিকে সারাদেশে মৃদু বা মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ দেখা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ ডক্টর মুহাম্মদ আবুল কালাম মলিস্নক। সূত্র : বিবিসি বাংলা