আজ চলতি অর্থবছরের শেষ ছয় মাস অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুনের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার কমানোসহ বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি ও ব্যাংকিং খাতে তারল্য বাড়ানো থাকবে নতুন মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য।
এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট উচ্চ মূল্যস্ফীতি। ডলার সংকটের কারণে এ সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করছে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম বেড়ে আবার কমেছে, কিন্তু কমেনি দেশের বাজারে। অনেক দেশ মূল্যস্ফীতির কবল থেকে বেড়িয়ে আসলেও বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম।
তাই এবারের মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি কমানো হবে প্রধান লক্ষ্য। পাশাপাশি ডলারের বাজার স্থিতিশীল করা ও রিজার্ভ বাড়ানোর বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকবে।
নতুন সরকার গঠনের পর চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি থেকে জুন অর্থাৎ শেষ ছয় মাসের জন্য নতুন মুদ্রানীতি এটি। আগের বছরে মতোই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির খসড়া তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খসড়া মুদ্রানীতিতে এবারও নীতি সুদের হার আরও বাড়িয়ে টাকাকে অতিমূল্যায়িত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যাতে সুদহার বেড়ে মূল্যস্ফীতি কমে আসে। বাকি সব চলবে আগের মতোই।
গত নভেম্বরের শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণের হার কিছুটা বাজারভিত্তিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নীতি সুদের হারও বাড়িয়েছে। এতে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এদিকে তারল্য সংকট ও সুদহারের কারণে বেসরকারি খাতে
\হঋণপ্রবাহ নেমেছে তলানিতে।
আর্থিক নানা সংকটের মাঝে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, পর্যাপ্ত তারল্য না থাকা, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতা এবং নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাংক খাত। আর এসব সমস্যার মধ্যেই ঘোষিত হচ্ছে মুদ্রানীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে মুদ্রানীতির অন্যতম লক্ষ্য। এজন্য চলমান সব ধরনের নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব সংকোচনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো চলমান থাকবে।
গত ছয় মাসে দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে। ৯ থেকে বেড়ে চলতি জানুয়ারিতে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার উঠেছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছিল। যদিও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে দেখা যায়নি।
নতুন বছরের প্রথম ছয় মাসের মুদ্রানীতিতেও নীতি সুদের হার আরও বাড়িয়ে টাকার অবমূল্যায়ন কমানো হবে। এতে সুদহার বেড়ে মূল্যস্ফীতি কমে আসে। মূলত নীতি সুদহারসহ ব্যাংক ঋণের সব রকম সুদ আরও বাড়িয়ে সংকোচনমুখী ধারা অব্যাহত রাখা হবে।
বোর্ড সভায় উপস্থিত সূত্র জানায়, এবার ঘোষণা দেওয়ার পরও বাজারভিত্তিক হচ্ছে না ডলারের দর। ডলার সংকট সহনীয় পর্যায়ে না আসায় এ মুদ্রার দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না আসন্ন মুদ্রানীতিতে।
ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার চাপ রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। কিন্তু একেবারে বাজারভিত্তিক না করলেও ডলারের দর কিছুটা বাড়বে বলে আভাস পাওয়া গেছে। বর্তমানে ব্যাংকের সঙ্গে বাজারের ডলারের দর অন্তত ১০ টাকা পার্থক্য। কোথাও কোথাও আরও বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইট অনুযায়ী ডলারের দর ১১০ টাকা হলেও ব্যাংকগুলো ১১৫ থেকে ১২০ টাকা দরে ডলার বিক্রি করছে। এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে ১২৫ টাকা পর্যন্ত প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। তাই ডলারের দর কিছুটা বাড়াবে।
এই প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে থেকে তিন জন অর্থনীতিবিদকে নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। ফলে এবারের মুদ্রানীতির দিকে সবার নজর। মুদ্রানীতির কমিটিতে গভর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রয়েছেন অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান মাসুদা ইয়াসমীন।
এর আগে গত বছরের ২২ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড সভায় ৭ সদস্য বিশিষ্ট মুদ্রানীতি কমিটি পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গভর্নরসহ চারজন ও বাইরের তিনজন মোট সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এর আগে বেসরকারি খাতের কোনো ব্যক্তি মুদ্রানীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। ফলে অর্থনীতিবিদদের অভিযোগ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান না থাকায় মুদ্রানীতি অনেকটা কাগজেই থেকে যায়।