দেশে বোরো ধান রোপণের মৌসুম চলছে। চাষাবাদের জন্য সার, ডিজেল ও বিদু্যতের পিক সিজন এখন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গত বছর থেকেই সারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপর গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকায় বিক্রি হলেও অক্টোবর মাসে লিটারে ডিজেলের মূল্য ১০৯ টাকা ৪৪ পয়সা করা হয়েছে। দেশের কোথাও কোথাও সরকারের নির্ধারিত দামে মিলছে না ডিজেল। অধিকাংশ এলাকায় ১১২ থেকে ১১৫ টাকায় কিনতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। হাঠৎ ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে মৌসুমের শুরুতেই হোঁচট খাচ্ছেন কৃষকরা। এ অবস্থায় কৃষকরা এবার ডিজেলে ভর্তুকির দাবি জানিয়েছেন।
এর আগে ২০১০ সালে বোরো মৌসুমে আওয়ামী লীগ সরকার ৯১ লাখ কৃষককে সেচে ডিজেলের ভর্তুকি হিসেবে ৭৫০ কোটি টাকা প্রদান করে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট ও নেত্রকোনায় এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেছিলেন। এরপর থেকে বাজেটে সরকার সেচ কাজে ডিজেলের ভর্তুকি হিসেবে ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও কয়েক বছর ধরে ভর্তুকির অর্থ সার খাতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। গত বছরও প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা সারে ভর্তুকি দেয় সরকার। আমন মৌসুমে খরায় ফসলের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবারও কৃষকরা ডিজেলে ভর্তুকি দাবি করেছেন।
খুচরা পর্যায়ে এলাকাভেদে ডিজেলের লিটারে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন দেশের ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গাচাষি কৃষকরা। তারা চলতি বোরো ধান উৎপাদনে সেচ কাজে ব্যবহৃত ডিজেলে ভর্তুকি দাবি করেছেন। বোরো মৌসুম পুরোপুরি সেচনির্ভর। এই মৌসুমে ধান উৎপাদনে সেচ বাবদ খরচ হয় ৪৬ শতাংশের বেশি। মৌসুমের শুরুতে ধান
ক্ষেত প্রস্তুত করতে সেচের জন্য ডিজেল ও সারের প্রয়োজন হয়। সার ও ডিজেল নগদ টাকায় কিনতে হয়। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে শুরুতেই হিমশিম খাচ্ছেন কৃষক। পুঁজিতে টান পড়েছে অনেকের। অনেকে মহাজনের কাছে ঋণের জন্য ধর্ণা দিচ্ছেন।
এরপরও লোকসানের আশঙ্কা মাথায় নিয়ে কাকডাকা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কৃষকরা জমিতে হাল চাষ, চারা তোলা এবং রোপণের কাজ করছেন। বিদু্যৎ, সার ও ডিজেলের সংকট এবং আগাম বন্যা না হলে এবারও বাম্পার ফলন হবে। এমন আশা কৃষকদের।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যানুযায়ী, দেশের এক কোটি ২৩ লাখ কৃষক ডিজেলচালিত যন্ত্রের মাধ্যমে সেচকাজ পরিচালনা করেন কৃষক। দেশে প্রায় ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডিজেল পাম্প এবং ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৮৫১টি বৈদু্যতিক পাম্প রয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ১৬ লাখ টন ডিজেল সেচকাজে ব্যবহার করা হয়। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব কৃষি উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ৩২ টাকা বাড়ায় কৃষকের বাড়তি খরচ হবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। সরকার বিদু্যৎ চালিত সেচ পাম্পগুলোকে ২০ শতাংশ ভর্তুকি দিলেও ডিজেলচালিত সেচ পাম্পগুলো কোনো ভর্তুকি পায় না। এতে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গাচাষিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।
সেচ খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না তাদের। কৃষকরা বোরো মৌসুমে চাষাবাদে সেচের জন্য ডিজেলে ভর্তুকি চেয়েছেন। ভর্তুকি না পেলে উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে তারা লাভের মুখ দেখতে পারবেন না বলে আশঙ্কা। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সেচের পিক সিজন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেচে বিদু্যৎচালিত পাম্পের ব্যবহার বাড়লেও এখনো বিপুলসংখ্যক কৃষক ডিজেলচালিত পাম্প ব্যবহার করেন।
নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বারমারি গ্রামের কৃষক অনিল হাজং জানান, 'ডিজেলের দাম বাড়ায় এবার কাঠাপ্রতি (৮ শতাংশ) জমিতে সেচের পানি দিতে এক হাজার টাকা চাচ্ছে। তারপর সার, ডিজেল, কীটনাশক, কামলা খরচ আছে। সেচ খরচ নিয়ে কথা উঠলে সময়মতো পানি দিবে না পাম্পের মালিক। তাই নতুন সরকারের কাছে আগের মতো সাহায্য চাই।'
ময়মনসিংহের গাছতলা বাজারের পাশের কৃষক জামাল উদ্দিন জানান, ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচ খরচ বাড়বে। মৌসুমে ধানের ভালো দাম পাওয়া যায় না।
নওগাঁ সদর উপজেলার চকপ্রাণ গ্রামের বর্গাচাষি জানান, 'হঠাৎ ডিজেলের দাম বাড়ায় কৃষক ও ডিলারদের মধ্যে গ্রামে গ্রামে ঝগড়া-বিবাদ হচ্ছে। দ্রম্নত দাম কমানোর দাবি জানাই।'
সুনামগঞ্জের শনির হাওড়ের কৃষক আব্দুল হাই জানান, 'ডিজেলে বা সারে ভর্তুকি দিলে মহাজন বা এনজিও থেকে ধার নিতে হবে না। সরকার আগে যেভাবে কৃষকের ১০ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সার ও ডিজেল ভর্তুকির টাকা দিত সেভাবে নগদে দেওয়ার অনুরোধ করছি। মৌসুমের শুরুতেই সার ও ডিজেল কিনতে নগদ টাকার দরকার হয় বেশি।'
গ্রামীণ কৃষক আন্দোলনের মহাসচিব সফিকুল ইসলাম যাযাদিকে বলেন, বোরো আবাদ সম্পূর্ণ সেচনির্ভর। ফলে এ ধান চাষে মোট খরচের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয় সেচ কাজে। চলতি মৌসুমে কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সার ও বীজ ধান কিনতে এবং সেচসহ বিঘাপ্রতি খরচ প্রায় তিন হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কৃষকরা উৎপাদন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। খাদ্য উৎপাদনের স্বয়ং সম্পূর্ণতা ধরে রাখতে নতুন সরকারের কাছে ডিজেলে ভর্তুকি যথার্থ দাবি কৃষকের।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য বলছে, বোরো মৌসুমে প্রায় ১৮ লাখ টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ডিজেল ব্যবহার হয় বেশি। ডিসেম্বর মাসে ধানক্ষেত প্রস্তুতের সময় সেচের জন্য ডিজেলের প্রয়োজন হয় প্রায় দুই লাখ টন। জানুয়ারি মাসে প্রায় আড়াই লাখ টন ডিজেল ব্যবহার হয়। আর ফ্রেরুয়ারিতে ব্যবহার হয় প্রায় পাঁচ লাখ টন। মার্চ মাসে সেচে ডিজেল লাগে পাঁচ লাখ ২০ হাজার টন। এপ্রিল আর মে দুই মাসে ব্যবহার হয় চার লাখ টন ডিজেল।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে বছরে সারাদেশে ২৫ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বোরো মৌসুমের জন্য প্রয়োজন হয় ১৩ লাখ ১৯ হাজার ৪৯১ টন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয় তিন লাখ ৯৬ হাজার টন। ফেব্রম্নয়ারিকে সার লাগে ৪ লাখ ১১ হাজার টন আর মার্চ মাসে প্রয়োজন পড়বে দুই লাখ ২৩ হাজার টন। ইতিমধ্যে সরকার বোরো মৌসুমের জন্য ১৫ লাখ টন সারের মজুত করেছে।
বিদু্যৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বোরো মৌসুমে সেচ কাজে বিদু্যতের চাহিদা ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৩৪৭ মেগাওয়াট, ফেব্রম্নয়ারি মাসে ৮৬৫ মেগাওয়াট, মার্চ মাসে ১ হাজার ৯৪৯ মেগাওয়াট, এপ্রিল মাসে ১ হাজার ৯৮৯ মেগাওয়াট এবং মে মাসে ২ হাজার ৫৯০ মেগাওয়াট বিদু্যতের প্রয়োজন হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন বিভাগের পরিচালক তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী যায়যায়দিনকে জানান, চলতি মৌসুমে এবার ৫০ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ থেকে উৎপাদনের টার্গেট ধরা হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ ৬৪ হাজার টন ধরা হয়েছে। এবার বোরো মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের আবাদ বাড়ানো পরিকল্পনা করা হয়েছে। সারা দেশে বোরো রোপণে কৃষকরা মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন।