বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১
শ্রীমঙ্গলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯.৭ ডিগ্রি আরও এক ডিগ্রি কমে ঢাকায় ১৩.৮

কনকনে শীতে বৃষ্টির পূর্বাভাস তাপমাত্রা আরও কমার শঙ্কা

যাযাদি ডেস্ক
  ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সন্তানকে ওড়না দিয়ে ঢেকে শীত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছেন মা। ছবিটি মঙ্গলবার তেজগাঁও এলাকা থেকে তোলা -নাজমুল ইসলাম

কয়েকদিন ধরেই হাড় কাঁপানো শীতে বিপর্যস্ত সারাদেশ। মাঘে এসে পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়েছে। 'মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে' প্রবাদটিই যেন সত্যি করে তুলেছে প্রকৃতি। শীতের প্রকোপে ভোগান্তিতে পড়েছেন দেশের ছিন্নমূল ও নিম্নআয়ের মানুষ, যা এখন চরম আকার ধারণ করেছে। তীব্র শীতের কারণে শ্রমজীবী অনেকের ভাগ্যে মিলছে না কাজ। পাশাপাশি বেড়েছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ। সূর্যের দেখা নেই বেশ কদিন ধরেই, কুয়াশায় আকাশ ঢাকা থাকছে সারাদিনই। সেইসঙ্গে আরও ভয় ধরানোর খবরই জানালো আবহাওয়া অধিদপ্তর। সংস্থাটি এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে, পুরো জানুয়ারি জুড়েই এমন আবহাওয়া বিরাজ করতে পারে। এমনকি আজ বুধবার থেকে রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে হালকা বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি শুরু হতে পারে। এছাড়া ২০ জানুয়ারির পর থেকে তাপমাত্রা আবারো কমার আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।

মঙ্গলবার আবহাওয়াবিদ শাহিনুল ইসলাম বলেন, 'এই বৃষ্টির কারণে আকাশ মেঘলা থাকতে পারে। তবে সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। বৃহস্পতিবার রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে হালকা

বৃষ্টি বা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে।'

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল শ্রীমঙ্গলে ৯.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা গতকাল ছিল বরিশালে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া ঢাকার তাপমাত্রা ১৪.৮ থেকে ১ ডিগ্রি কমে ১৩.৮ ডিগ্রিতে নেমেছে। অন্যদিকে ১২ ডিগ্রির নিচে থাকা অঞ্চলগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে ১০; বান্দরবানে ১০.২; নওগাঁর বদলগাছীতে ১০.৩; বগুড়ায় ১০.৪; পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ১০.৭; বরিশালে ১০.৮; ভোলা, নীলফামারীর ডিমলা ও কিশোরগঞ্জের নিকলীতে ১১; খুলনায় ১১.৩, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও দিনাজপুরে ১১.৪, রাঙামাটিতে ১১.৫; নীলফামারীর সৈয়দপুরে ১১.৬; চট্টগ্রামে ১১.৭; রংপুর, রাজশাহী ও গোপালগঞ্জে ১১ দশমিক ৮; কুষ্টিয়ার কুমারখালী ও পাবনার ঈশ্বরদীতে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে, যার বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।

পূর্বাভাসে কুয়াশার বিষয়ে বলা হয়েছে, আজ সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি কোথাও কোথাও বুধবার দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগে সাময়িকভাবে বিঘ্ন ঘটতে পারে।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমে এলে শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করে। এই হিসাবে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের তাপমাত্রার ব্যবধান ৩ ডিগ্রি কমে এসেছে। তাপমাত্রার এই পার্থক্য যদি ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসে, তাহলেই শীতের অনুভূতি বাড়তে থাকে। আর যদি পার্থক্য পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসে তবে শীতের অনুভূতি প্রকট থেকে প্রকটতর হয়। অর্থাৎ হাড় কাঁপানো শীত অনুভূত হয়।

আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান বলেন, 'তাপমাত্রা কমেছে কিন্তু সব এলাকায় শৈত্যপ্রবাহ বইছে না। ঢাকায় শীতের অনুভূতি বেশি হওয়ার কারণ সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়া। দেশের অন্যান্য এলাকায় তাপমাত্রার পার্থক্য এখন কম। তাই শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। জানুয়ারি মাসজুড়ে শীতের তীব্রতা থাকতে পারে।'

শীতে জড়সড় তেঁতুলিয়াবাসী

তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) প্রতিনিধি জানান, মাঘের তীব্র শীতে জড়সড় উত্তরের জনপদ তেঁতুলিয়া। টানা ঘন কুয়াশা আর হিমেল বাতাসের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ জনপদের মানুষ। শীতের কারণে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। মঙ্গলবার সকালে ১০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মঙ্গলবার ভোর থেকে ঘন কুয়াশার চাদরে আচ্ছন্ন ছিল জনপদ। বৃষ্টির মতো ঝরছে কুয়াশার শিশির। অনেকেই জীবিকার তাগিদে শীত উপেক্ষা করে কাজে বের হয়েছেন। দুপুরের পরেও দেখা মেলেনি সূর্যের।

ভ্যানচালক আবুল কালাম ও দেলোয়ার জানান, কুয়াশা ও ঠান্ডার কারণে কামাই কমে গেছে। সহজে ভ্যানে চড়তে চায় না কেউ- এ জন্য তারা টিপ মারতে পারছেন না।

এদিকে শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে জেলা ও উপজেলার হাসপাতালগুলোর আউটডোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা।

জেলার প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ বলেন, ভোর থেকে ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন পঞ্চগড়। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ঘন কুয়াশার কারণে দেখা মিলছে না সূর্যের। উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হওয়ার কারণে শীতের তীব্রতা বাড়ছে।

রাজশাহীতে কাজ পাচ্ছেন না শ্রমজীবীরা

এদিকে, রাজশাহীতে শীতের দাপটে জবুথবু অবস্থা সাধারণ মানুষের। সবচেয়ে বেশি কষ্ট শ্রমজীবী মানুষের। তীব্র শীত উপেক্ষা করে কেউ কেউ কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তবুও মিলছে না কাজ। রাজশাহী চারঘাট উপজেলার শুকুর আলী ভোর ৪টার দিকে রাজশাহী আসেন কাজের খোঁজে। তবে দীর্ঘ অপেক্ষার পরও মেলেনি কাজ।

তিনি বলেন, 'বাসা থেকে ভোর ৪টায় বের হয়েছি, কাজ এখনো পাইনি। ঠান্ডার জন্য কেউ কাজে নিচ্ছে না। কাজ না করলে খাবো কী?'

শুকুর আলীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মজিদ আলী। তিনি বলেন, 'খুব ঠান্ডা পড়ছে। ৮-৯ দিন পর বাসা থেকে বের হয়েছি। চারদিকে অনেক কুয়াশা, কাজ-কাম নাই, বয়সও হয়ে গেছে, কেউ কাজে নিচ্ছেও না। আমরা চলব কীভাবে?

আবহাওয়া অফিস বলছে, চলতি মাসে রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯.৬ ডিগ্রি। এছাড়া সপ্তাহজুড়ে বিভাগের আট জেলায় তাপমাত্রা ওঠানামা করছে ৯ থেকে ১২ ডিগ্রিতে। আগামী কয়েক দিন রাজশাহীর আবহাওয়া পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে, সেই সঙ্গে হতে পারে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি।

কৃষি অধিদপ্তর বলছে, এমন আবহাওয়া অব্যাহত থাকলে কৃষির জন্য হবে অভিশাপ। প্রভাব পড়বে আলুসহ বোরোতে। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ রহিদুল ইসলাম বলেন, 'আজ বুধবার থেকে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে। রৌদ্রোজ্জ্বল থাকলেও রাতের তাপমাত্রা একটু কমবে। তবে বৃষ্টির পরদিনের তাপমাত্রা একটু বাড়বে।'

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, 'এমন আবহাওয়ায় বিশেষ করে আলুর ওপর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষকদের ব্যাপকভাবে সচেতন করছি। যারা বোরো ধান রোপণ করেছে তাদের একটু সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে যদি পানি নিয়মিত না দেওয়া যায় তাহলে চারা মারা যেতে পারে।'

রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, 'শীতার্তদের পাশে দাঁড়াতে সামর্থ্যবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। আমরাও সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি।'

মৌলভীবাজারে বইছে শৈত্যপ্রবাহ

মৌলভীবাজার থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, পর্যটন ও পাহাড়ি জেলা মৌলভীবাজারে মাঘ মাসের শুরুতে ফের জেঁকে বসছে শীত। একদিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা কমে নেমে এসেছে ৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে; যা সোমবার ছিল ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পুরো জেলাজুড়ে বইছে শৈত্যপ্রবাহ। কনকনে শীত ও হিমেল হাওয়ার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দিন রাত সমান তালে বইছে কনকনে হিমেল হাওয়া। পাশাপাশি ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে রয়েছে গোটা এলাকা। গত এক সপ্তাহ থেকে এ জেলায় সূর্যের দেখা মেলেনি।

শীতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন কুশিয়ারা নদী ও হাওড় পাড়ের মানুষ, চা বাগানের শ্রমিক, ছিন্নমূল ও দিনমজুররা। অনেকেই খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।

\হমৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলস্থ আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা বিবলু চন্দ্র জানান, মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘন কুয়াশা কেটে গেলে তাপমাত্রা আরও নামতে পারে।

\হমৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক বিনেন্দ্র ভৌমিক জানান, শুধু শিশুদের জন্য সিট রয়েছে ৩৯টি। গত সপ্তাহে শীতজনিত রোগে হাসপাতালে শিশু ভর্তি ৭০-৭৫ জন ছিল। যা প্রায় দ্বিগুণ ভর্তি ছিল। বর্তমানে শিশু ভর্তি কমে আসছে।

এছাড়াও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকমপেস্নক্সেগুলোতে শিশুরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। পৃথকভাবে প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালে শিশুরা চিকিৎসা নিচ্ছে। ফুটপাতে গরম কাপড়ের দোকানে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ভিড় প্রতিদিন বাড়ছে।

\হমৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার শাহপুর গ্রামের সুয়েজ মিয়া বলেন, 'বোরো আবাদি জমিতে সেচ ও পাওয়ার টিলার দিয়ে কাজ করা যাচ্ছে না। এত ঠান্ডা পানি ও বাতাস। যে কাজ করাই কঠিন হয়ে গেছে। একই এলাকার কৃষক আজমল আলী জানান, কয়েক দিনের অতিরিক্ত শীত ও হিমেল বাতাশের কারণে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। বেশি সময় পানি ও কাঁদার মধ্যে কাজ করা যায় না।'

\হমৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ জানান, এ বছর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬১ হাজার হেক্টর জমি। ঘন কুয়াশার কারণে বীজতলা ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। তারা কৃষকদের চারা গাছগুলো পাতলা পলিথিন দিয়ে প্রতি রাতে ঢেকে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। এছাড়াও কুয়াশা কমে গেলে পলিথিন সরিয়ে একটি কাটি দিয়ে চারা গাছের আগা থেকে কুয়াশার পানি ফেলে দেয়ারও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে