ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রিজার্ভ থেকে ৬৭০ কোটি মার্কিন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও এক হাজার ৩৩৮ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়। দেড় বছরে এ বিক্রির পরিমাণ বর্তমান রিজার্ভের সমপরিমাণ। এরপরও ডলার সংকটে আমদানিকারকরা সহসা এলসি খুলতে পারছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, নির্বাচনের বছর হওয়ায় গত দেড় বছরে অর্থ পাচার বেড়েছে। যে কারণে আমদানি বিল বেশি হচ্ছে, একই সময় রপ্তানি বিল কম। আমদানি-রপ্তানির এই ফারাক অর্থ পাচারের লক্ষণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর বাইরেও অনেকে ডলারের সংকট বাড়তে পারে বা দাম বাড়তে পারে এমন আশায় ডলার হাতে রেখে দিচ্ছেন।
পাশাপাশি অনেকে কালো টাকা (অপ্রদর্শিত অর্থ) দিয়ে ডলার কিনে হাতে রাখছেন। এমনকি ব্যাংকের লকারেও অনেকে ডলার রাখছেন বলেও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এটি কেউ অফিসিয়ালি বলছে না। ব্যাংকের মালিকপক্ষ বা ভালো সম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তিরা এসব টাকা রাখছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তদন্ত করলে বিষয়টি বেড়িয়ে আসবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এর বাইরেও সরকারের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ডলার খরচ হচ্ছে। যেমন সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে ডলার খরচ হচ্ছে। অনেক ঋণ আছে ডলারের দর যখন ৮৫ টাকা ছিল তখন নেওয়া। এখন সেই ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে ১২০ টাকা দরে। ফলে ডলার কিনতে খরচ বেড়ে গেছে।
বিগত ছয় মাসে যে ডলার বিক্রি করা হয়, তা ৭৩ হাজার ৭শ' কোটি টাকার সমপরিমাণ। বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক এক হাজার ৩৩৮ কোটি ৫১ লাখ মার্কিন ডলার নিট বিক্রি করেছিল, যা টাকার পরিমাণে এক লাখ ৪৭ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। মূলত ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং সহজলভ্য করতেই রিজার্ভ থেকে এ ডলার বিক্রি করা হয়। এরপরও দর নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ডলারপ্রতি টাকার মূল্যমান জুন'২৩ এবং সেপ্টেম্বর '২২ শেষের তুলনায় যথাক্রমে শতকরা ১.৯৪ ভাগ এবং ৮.১৪ ভাগ অবচিতি হয়ে সেপ্টেম্বর'২৩ শেষে ১১০.৫০ টাকায় দাঁড়ায়। গত জুন'২৩ এবং সেপ্টেম্বর'২২ শেষে টাকা-ডলার বিনিময় হার ছিল যথাক্রমে ১০৮.৩৬ এবং ১০১.৫০ টাকা। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে টাকা-ডলার
বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ১১০.২৫ টাকা।'
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, 'বিনিময় হারের অবচিতি চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ডলার বিক্রয় করে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জুলাই-নভেম্বর ২০২৩ সময়ে ৫ হাজার ৫৬৬.৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিট বিক্রয় করা হয়েছে। বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ১৩ হাজার ৩৮৫.১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিট বিক্রয় করা হয়েছিল।'
এদিকে অব্যাহতভাবে ডলারের সংকটের কারণে আমদানিকারকরা ডলার পাচ্ছে না। এমনকি বিদেশি উচ্চ শিক্ষা বা চিকিৎসার জন্য ডলার পাচ্ছে না। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী রোববার ডলারের দর ছিল ১১০ টাকা। সিংহভাগ ব্যাংকই আনুষ্ঠানিক দাম না মেনে ডলারপ্রতি ১১৪ থেকে ১১৬ টাকা রেটে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলছে। অনুমোদিত এক্সচ্ঞ্জে হাউসগুলোতে ডলার ১২৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রি করা হচ্ছে।
বর্তমানে ২৩৫টি অনুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জার থাকলেও এক হাজারের বেশি মানি এক্সচেঞ্জার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই অনঅনুমোদিত এক্সচেঞ্জারগুলোই চড়া দামে ডলার ক্রয়-বিক্রয় করছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে অনঅনুমোদিত এক্সচেঞ্জারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এত বড় সিন্ডিকেট ধরতে অভিযান খুবই কম। তাই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম থামছে না।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম ১০৯.৫০ টাকা, রপ্তানিতে ১০৮.৫০ টাকা, রেমিট্যান্সে ১০৯ টাকা ও আমদানিতে ১০৯.৫০ টাকা ঘোষণা করে। কিন্তু এই ঘোষণা কাগজে-কলমেই থেকে গেছে। কিন্তু নগদ ডলার এ দামে এক্সচেঞ্জারগুলো বিক্রি করছে না।
রোববার সরেজমিন উত্তরার আমির কমপেস্নক্সের কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জে গিয়ে দেখা গেছে, ১২৪ টাকা থেকে ১২৫ টাকা বিক্রি করছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে হওয়ায় আশপাশে ডলারের ব্যবসা রমরমা। খোলা বাজারে ১৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে অনেকে। রাজধানীর মতিঝিলেও অনেকটা একই দৃশ্য।
এদিকে, ডলারের দর বাড়ায় রিজার্ভ বাড়ছে না। গত কয়েক মাস ধরে ২০ বিলিয়নের আশপাশে ওঠানামা করছে। সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি আকুর দায় পরিশোধের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সনাতন পদ্ধতির হিসাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫.৬৫ বিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি মতে (বিপিএম৬ অনুযায়ী) দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২০.৪ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সনাতন পদ্ধতিতে বৃহস্পতিবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৬.৯৯ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ২১.৭৪ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে দেশের ইতিহাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে। তবে ২০১৭ সালে রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করেছিল। আর বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর আগ পর্যন্ত রিজার্ভ ৩২ থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ওঠানামা করছিল।
তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাজারে সুদহার অনেক কমে আসে। এতে অনেক দেশ বিদেশি ঋণ কমালেও বাংলাদেশে বেড়ে যায়। এ কারণে আগের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাড়তি চাপ তৈরি হয়।
অন্যদিকে দেশের মধ্যে তীব্র ডলার সংকটে খোলাবাজার পরিস্থিতিও টালমাটাল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে সংকট আরও জটিল হয়। এ কারণে বাধাগ্রস্ত হয় এলসি খোলা। অনেক ব্যাংক এখনো এলসি খুলতে পারছে না, নিষ্পত্তিতেও ভোগান্তিতে পড়েছে। আর বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ করে জরুরি পণ্য আমদানিতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে প্রতি মাসে বাজারে ডলার চলে যাওয়ায় কমছে রিজার্ভের পরিমাণ।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক আশীর্বাদে অনেকে অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছে। তারাই অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। সরকারের উচিত আর নতুন প্রকল্প না নেওয়া। বিদেশ ভ্রমণ অর্থ ব্যয় ও বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এটি কার্যকর হচ্ছে না। আর বাংলাদেশ ব্যাংকেও রিজার্ভ কমে যাওয়ার ভয়ে বেশি ডলার বিক্রি করতে পারছে না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সাইন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, সরকারের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ডলার খরচ হচ্ছে বলা হলেও পাচার এবং হোল্ডিং করা হচ্ছে। ডলার এখন ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে গেছে। আনঅফিসিয়ালি শোনা যাচ্ছে অনেকে ডলার ব্যাংকের লকারে রাখছে। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে হবে।