সময় নিয়ে ফের মাঠে নামতে চায় বিএনপি
প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
সরকার পতনের এক দফার আন্দোলন এখন উত্তাপহীন। রাজপথের হরতাল-অবরোধ নেই। নেই আগের মতো ধর-পাকড়। গ্রেপ্তার আতঙ্কও অনেকটা কেটে গেছে। এর পরেও ব্যর্থ আন্দোলনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আরেকটু সময় নিয়ে ফের রাজপথের কঠোর আন্দোলনে যেতে চায় বিএনপি। এর আগে নেতাকর্মীদের মুক্ত, সংগঠন পুনর্গঠন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হতে চায় দলটি।
বিএনপির প্রভাবশালী একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচন-পরবর্তী কঠোর কর্মসূচি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। তাদের শঙ্কা বিএনপির এই নীরবতা আবারও ক্ষমতাসীনদের পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে উৎসাহ জোগাবে। কিন্তু দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই মুহূর্তে কঠোর কর্মসূচিতে থাকলে বিএনপির বিপর্যয় আরও বাড়বে। কিন্তু সময় নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মুক্ত করে আন্দোলনের মাঠে নামলে তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আরও বৃদ্ধি পারে। তখন আন্দোলন কার্যকর হবে।
বিএনপির দাবি, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ পন্ড হয়ে যাওয়ার পর থেকে সারাদেশে তাদের ২৭ সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই গণগ্রেপ্তারের প্রভাব পড়ছে ওইসব নেতাকর্মীর পরিবারের ওপর। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি তাদের কর্মজীবনও ধ্বংসের মুখে। এসব নেতাকর্মী নির্ভর বিএনপির এখন আন্দোলন করার মতো অবস্থায় নেই। এজন্য বিলম্ব করতেই হবে।
জানা গেছে, নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে ধারাবাহিকভাবে কঠোর কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার চাপে ছিল হাইকমান্ড। এ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। বৈঠকগুলোতে আপাতত বড় ধরনের কঠোর কোনো কর্মসূচি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিলে সেটিকে ঘিরে অন্য কোনো পক্ষ নাশকতা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর এর দায় চাপিয়ে দেয়। বিএনপি সরকার বা অন্য কোনো পক্ষকে এমন সুযোগ দিতে চায় না। কারণ, বিএনপির বহু নেতাকর্মী এখন কারাগারে। আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকে ঘরছাড়া, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের আগে কারামুক্ত করা দরকার। এখন কঠোর কর্মসূচিতে গেলে তাদের জামিন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে।
নেতাদের ধারণা, নির্বাচন হয়ে গেছে। এখন সরকার তাদের মুক্তিতে বাধা সৃষ্টি নাও করতে পারে। সরকার বাধা না দিলে কম সময়ের মধ্যে তারা জামিনে কারামুক্ত হতে পারেন। তাতে দল নতুন করে সুসংগঠিত, চাঙা হবে দল। আন্দোলন এগিয়ে নিতে যা সহায়ক হবে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরেও আন্দোলন ফলপ্রসূ না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বিএনপিতে নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে যথেষ্ট ঘাটতি। তাই পরবর্তী কঠোর আন্দোলন শুরু করার আগে এই ঘাটতি পূরণ চায় তারা। দ্রম্নত যোগ্য ও মেধাবী নেতৃত্বের মাধ্যমে দল পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক উইংকেও আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করার বিষয়েও ভাবা হচ্ছে।
বিএনপি সিনিয়র এক নেতা জানান, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে 'একদফা' আন্দোলনে হাল ছাড়ছে না বিএনপি। আশাবাদী দলের হাইকমান্ড আবারও নতুন উদ্যোমে জনগণকে সম্পৃক্ত করে, নেতাকর্মীদের আবারও সংগঠিত করে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছেন। সবকিছু ঠিক করে সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্দোলনের পরবর্তী ধাপেও আন্তর্জাতিক বিশ্ব আর দেশের জনগণের সমর্থন অব্যাহত রাখার কৌশল গ্রহণের পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদেরও চাঙা রাখতে কাজ করছেন দলের নেতারা।
আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, বিএনপি ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে না, বিএনপি রাজনীতি করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত তারা রাজপথের আন্দোলনে আছেন, রাজপথের আন্দোলনে থাকবেন।
একই বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি আন্দোলন প্রত্যাহার করেনি। ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এক ধারায় হয়েছে। এখন কোন ধারায় আন্দোলনে যাব তা সবার সঙ্গে কথা বলে ঠিক হবে। একদফা দাবিতে সরকারের পতনের পরবর্তী আন্দোলনের ধারা ঠিক করছে বিএনপি। এজন্য দলটির নেতৃবৃন্দরা প্রায় প্রতিদিনই বৈঠক করছেন। পরবর্তীতে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে।
জানা গেছে, এই মুহূর্তে জোরালো কোনো আন্দোলনে যাচ্ছে না বিএনপি। তবে আগামী ১৯ জানুয়ারি দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৮৮তম জন্মদিন উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি দিতে পারে বিএনপি।
বিএনপি ফের গুছিয়ে উঠে মাঠের রাজনীতিতে ফিরতে চায়। এর অংশ হিসেবে ৭৫ দিন পর গত বৃহস্পতিবার বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মতামত নিচ্ছে বিএনপি। ভার্চুয়াল মাধ্যমে গত মঙ্গলবার ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু করে। যা গত শুক্রবার যুগপৎ আন্দোলনের শুরুত্বপূর্ণ মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। প্রাথমিক মূল্যায়নে, আন্দোলনের ফসল চূড়ান্তভাবে ঘরে না তুলতে পারাকে ব্যর্থতা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। গত শনিবার গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে বৈঠক করে বিএনপি। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে প্রথমে দলটির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য এবং পরে স্থায়ী কমিটি ও হাইকমান্ডের বৈঠক হয়।
\হবৈঠক সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা প্রসঙ্গে কমপক্ষে পাঁচটি এজেন্ডা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেখানে বিএনপি জোটের আহ্বানে জনগণের ভোট বর্জন করাকে আন্দোলনের 'নৈতিক বিজয়' হিসেবে দেখা হলেও রাজপথের আন্দোলন কেন চূড়ান্ত সফলতা পেল না, কোথায় কোথায় ঘাটতি ছিল- তা নিয়ে আলোচনা হয়। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা তাদের মূল্যায়ন তুলে ধরেন। তারা বলেন, হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে জনগণ তাদের নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। সে কারণে দীর্ঘ সময় ধরে দূরপালস্নার যানবাহন চলেনি। কিন্তু কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতাকর্মীরা সেভাবে রাজপথে নামেনি, ঝটিকা মিছিলে বিক্ষিপ্তভাবে কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
নেতারা মনে করছেন, ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশের পরদিন রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশমুখে 'অবস্থান' এবং হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা প্রত্যাশিত হারে নামলে আন্দোলনের গতি পাল্টে যেত। বৈঠকে কর্মসূচি প্রণয়নে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি তুলে ধরে মঞ্চের নেতারা বলেন, আন্দোলনের শেষদিকে তাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই যুগপৎভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া কর্মসূচি প্রণয়নের প্রক্রিয়াও যথাযথ ছিল না। সব জোট ও দলের লিয়াজোঁ কমিটির সকল নেতার সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটিসহ আরও অন্য ফোরামে আলোচনার পর কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা ছিল দীর্ঘ প্রক্রিয়া। বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা এই সমন্বয়হীনতা দূরীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তারা আগামীতে যুগপতের প্রতি জোট থেকে শুধু সমন্বয়ক এবং বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির দুই-তিনজনের সমন্বয়ে বৈঠক থেকেই কর্মসূচি প্রণয়নের প্রস্তাব করেন। বিএনপি এ বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে বৈঠকে জানায়। এছাড়া বৈঠকে যুগপতের ভিত্তি হিসেবে রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা '৩১ দফা'কে নতুন করে ব্র্যান্ডিং করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটাকে এখন ব্যাপক পরিসরে জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে। তবে কীভাবে, কবে থেকে তুলে ধরা হবে, সে ব্যাপারটি চূড়ান্ত হয়নি। এ প্রসঙ্গে আলোচনায় মঞ্চের নেতারা বলেন, সরকার ও সরকারি দল দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনকে জ্বালাও-পোড়াওয়ের আন্দোলন এবং আন্দোলনের কোনো লক্ষ্য ও ক্ষমতাসীন হলে মানুষের জন্য কোনো ভিশন না থাকার কথা ধারাবাহিকভাবে বলে আসছে। অথচ ৩১ দফায় যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্য ও ভিশনের কথা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এটাকে আমরা দেশে-বিদেশে সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। বৈঠকে ভৌগোলিকসহ নানা কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে গণতন্ত্র মঞ্চ।
বৈঠকে কূটনীতিক ব্যর্থতা নিয়েও আলোচনা হয়। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলেন, বিএনপি একাধিকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু আন্দোলন ও নির্বাচন সামনে রেখে প্রভাবশালী দু-একটি দেশের কূটনীতিক ছাড়া অন্যদের তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক বিশ্বের জোরালো চাপও আসেনি। আগামী দিনে এই কূটনৈতিক ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে হবে।