কাজী ফিরোজ রশীদ ও সুনীল শুভ রায়কে অব্যাহতি

জাতীয় পার্টিতে ভাঙনের সুর!

প্রকাশ | ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
নতুন মন্ত্রিসভা গঠন হতে না হতেই ভাঙনের সুর শোনা যাচ্ছে জাতীয় পার্টিতে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি ভরাডুবির জন্য শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অসহযোগিতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতাসহ বিভিন্ন কারণ সামনে আনছেন জাপার একাংশের নেতাকর্মীরা। এমনকি ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে দলটির শীর্ষ নেতাদের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামও দিয়েছেন তারা। এদিকে, শুক্রবার জাতীয় পার্টির যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রওশন এরশাদপন্থি দুই কেন্দ্রীয় নেতা দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়কে দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দলীয় বিরোধীদের এই দাবির প্রেক্ষিতে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু অবশ্য বলছেন, 'এমন দাবি তোলার নৈতিক ও গঠনতান্ত্রিক কোনো অধিকারই তাদের নেই!' একই সঙ্গে দলের বিদ্রোহী ওই নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে মজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, 'যেকোনো কর্মী জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির বাইরে গিয়ে আরেকটা পার্টি করতে চাইলে আমরা বাধা দিতে পারি না। এই অধিকার তাদের আছে। কিন্তু জাতীয় পার্টি জি এম কাদেরের নেতৃত্বে আছে, এর ক্ষতি করার কোনো সুযোগ নেই।' তিনি আরও বলেন, 'যারা ইলেকশন করেননি, মনোনয়ন পাননি নির্বাচন যারা বর্জন করেছে তাদের পক্ষে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে এই কর্মকান্ডটি করছে। আমাদের বিতর্কিত করতে তারা এটা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে গঠনতান্ত্রিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' এবারের নির্বাচনে নিজেদের ভরাডুবির কারণ উলেস্নখ করতে গিয়ে জাপা মহাসচিব বলেন, আমরা কোনো শরিক না, জোট বা মহাজোটও না। আওয়ামী লীগ ২৬টি আসন ছাড় দিয়েছে তাদের স্বার্থে। আমাদের স্বার্থে না। ছাড় দেওয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা আবার জাতীয় পার্টির বিপরীতে কাজ করেছে। কাজেই একদিকে ছাড় দিয়েছে, আবার আরেক দিকে ছাড় দেয়নি। নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অর্থ, প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে নির্বাচনে সুবিধা করতে পারিনি, এটা সত্য। নতুন সংসদে বিরোধী দল হিসেবে যা যা করার দরকার সব করবেন জানিয়ে চুন্নু আরও বলেন, মোহের বিষয় নেই, দলীয় আইডেন্টিটি নিয়ে আমরা আছি। জনগণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, দলের স্বার্থে আমরা জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে যা যা করার সব করব। সেখানে কোনো আপস নেই। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা দলের বিক্ষুব্ধদের একজন। তিনি বলেন, 'সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় নেতা-কর্মীরা বলির পাঁঠা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিজেরা নেগোশিয়েশন করেছে দুই একজনের মধ্যে। আলাপ আলোচনা সেভাবে করেনি।' তিনি আরও বলেন, 'নমিনেশনের পর তারা সাহায্য করেনি। বিভিন্ন জেলায় নেতারা যারা ডিপ্রাইভড হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের আগে তাদের অর্থ দেয়নি, খোঁজ-খবর নেয়নি কীভাবে নির্বাচন হচ্ছে।' এদিকে, বুধবার পার্টি অফিসে গিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'নেতা হিসেবে তাদের যা করা উচিত ছিল, চেয়ারম্যান বা মহাসচিবরা তা করেননি।' এই পটভূমিতে পরবর্তী কী পদক্ষেপ তারা নেবেন এ বিষয়ে অবশ্য কোনো কথা বলেননি তিনি। অন্যদিকে, দলীয় সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ আরেকজন নেতা লিয়াকত আলী খোকা। তিনি বলেন, 'নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা ব্যর্থ। কারণ তারা একেকবার একেক ধরনের সিদ্ধান্ত নেন। একবার যাবে, আরেকবার যাবে না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে যেতে হলেও আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। দলীয় নেতৃত্ব। তারা এ জায়গায় ব্যর্থ।' লিয়াকত আলী খোকা আরও বলেন, 'জোটের সিট ছাড়া অন্য সিটে নির্বাচন চলাকালীন পার্টির মহাসচিব ও চেয়ারম্যান সারাদেশের নেতাকর্মীদের সহযোগিতা করেননি। নির্বাচনে নামাল, কিন্তু তারা কোনো খোঁজ-খবর করেনি। আমি অনেকবার যোগাযোগ করেছি; কিন্তু সাড়া পাইনি।' অতীতে '৯১ সালে যখন জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে হামলা-মামলা হয়, তখনো দলে এমন অবস্থা ছিল না উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'তারা সময়মতো সিদ্ধান্ত নেয়নি, এমন একটা সময় সিদ্ধান্ত হয় যখন নেতাকর্মীরা হতাশ। আমার নামও এলায়েন্স থেকে শেষের দিন উইথড্র করা হয়। ফলে দলীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিতে একেবারেই ব্যর্থ।' তিনি আরও বলেন, 'নির্বাচন সুষ্ঠু হলে এলাকায় পাস করব, সে আশাতেই নির্বাচন করছি। কিন্তু নেতৃত্বের ব্যর্থতায় জাতীয় পার্টির ভরাডুবির জন্য সারা দেশে নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ।' 'জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর কেন্দ্রীয় রাজনীতি করার আগে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না' উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'দলের প্রতি যে ফিলিংস, সারাদেশের নেতাকর্মীদের প্রতি তার দুর্ব্যবহারে সবাই কষ্ট পায়। মহাসচিব হিসেবে তিনি ব্যর্থ।' এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেকে নেতৃত্বও ছেড়ে দেয় বলে ইঙ্গিত করেন তিনি। লিয়াকত আলী খোকা আরও বলেন, ১১ জন (এমপি) ছাড়া দলের বাকিরা ক্ষুব্ধ। সিদ্ধান্ত নিতে যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থাকা দরকার তা এখানে হয়নি। সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা নিজে ঢাকা-৪ আসন থেকে লড়াই করে হেরে যান। তার ওই আসনে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ। সারাদেশেই জাতীয় পার্টির ক্ষুব্ধ ও হতাশ নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যেই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছেন। তবে, দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে একাধিকবার ফোন করলেও রিসিভ করেননি তারা। এরই মধ্যে বুধবার জাতীয় পার্টির নির্বাচিত ১১ জন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। গত বছরের ২২ নভেম্বর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় জাতীয় পার্টি। পরে ১৭ ডিসেম্বরে আসন সমঝোতা করে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দেয়। এসব আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে পরে ওই ২৬টি আসনের বাইরে বিভিন্ন আসনে দলীয় সমর্থন বা সহযোগিতার অভাব, সাংগঠনিক নেতৃত্বে অদক্ষতা, সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে থাকাসহ নানা অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাতীয় পার্টির একাধিক প্রার্থী। কিন্তু সমঝোতার মাধ্যমে যেসব আসন জাতীয় পার্টির জুটেছিল, সেখানে কেউ সরে না দাঁড়ালেও ভোটে টিকতে পারেননি অনেকেই। সে সময় যেসব প্রার্থী সরে দাঁড়ান তাদের সম্বন্ধে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছিলেন, 'কোনো প্রার্থী যদি নির্বাচন করতে না চায় তবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা ওই প্রার্থীর রয়েছে।' তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করলেও জাতীয় পার্টি কোনো জোটে নেই। বাংলাদেশের ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৯টি দল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগই জনসমর্থনে শক্ত ছিল। শুরুতে আওয়ামী লীগ সারাদেশে ২৯৮টি আসনে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে টিকেছেন তাদের ২৬৩ জন প্রার্থী। এর মধ্যে ঋণখেলাপি ও দ্বৈত নাগরিকত্বসহ নানা অভিযোগে পাঁচটি আসনে ওই দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। বিএনপির অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের পর জাতীয় পার্টিকেই একমাত্র রাজনৈতিক দল বা প্রতিপক্ষ মনে করেছিলেন অনেকে। কিন্তু গত দুই জাতীয় নির্বাচনের মতো এবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে যায় জাতীয় পার্টি। যা দলের ভেতরেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এছাড়া দলটি এককভাবে খুব বেশি আসন না পাওয়ায় আদৌ বিরোধী দল হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও বুধবার শপথ নিয়েই দলটির চেয়ারম্যান বিরোধী দলে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অবর্তমানে এবারই প্রথম দলীয় চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল দলটি। ২৮৩ আসনে প্রার্থী, ২৬ আসনে সমঝোতা হলেও নির্বাচিত হন দলের মাত্র ১১ জন। এর আগে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল হিসেবে ২৭টি আসনে জয় পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জেনারেল এরশাদ প্রাথমিকভাবে অংশগ্রহণ করতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে হয়েছিল। এরপর সমঝোতার মাধ্যমে ২০১৪ সালে ২৯টি এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২২টি আসনে জয়লাভ করে দলটি। সে সময় দলটির নেতাদের অনেকের কথায় সেই সমঝোতা নিয়ে অস্বস্তি চাপা থাকেনি। তখন দলটিকে ঘিরে নানা ধরনের তৎপরতাও দেখা গিয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। সূত্র : বিবিসি বাংলা