নিরাপত্তা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ

দীর্ঘমেয়াদি নাশকতার পরিকল্পনা থাকতে পারে হতে পারে চোরাগোপ্তা হামলা ও গুপ্তহত্যা প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশনা

প্রকাশ | ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
নির্বাচন শেষ হয়ে গেলেও সহিংসতার রেশ এখনো কাটেনি। নির্বাচন প্রার্থী সংশ্লিষ্ট প্রায় ৫ হাজার মানুষ আছেন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। ১০ জানুয়ারির সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার পরেই সম্ভাব্য সহিংস ঘটনা ঘটার তথ্য আছে গোয়েন্দাদের কাছে। সেই হিসাব করেই প্রস্তুতি নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন পরবর্তী আরও সহিংসতার আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে। যাতে সরাসরি মদত দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে দেশি-বিদেশি একাধিক গোষ্ঠীর। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রার্থী ও তাদের ঘনিষ্ঠদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা হতে পারে। গুপ্তহত্যার শিকার হতে পারেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের অনেকেই। বিষয়টি মাথায় রেখে সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে জয়ী ও পরাজিত এবং তাদের পরিবারের সদস্যসহ প্রতিদ্বন্দ্বীদের তালিকা। কয়েকটি ক্যাটাগরিতে করা তালিকায় স্থান পেয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি জন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া নাশকতা চলমান আছে। যদিও এখন পর্যন্ত তা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী মাঠে থাকছে। এজন্য দেশবাসী বাড়তি নিরাপত্তা বোধ করছেন। সশস্ত্র বাহিনী মাঠ থেকে চলে যাওয়ার পর নাশকতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে এবারের নাশকতার ধরন ভিন্ন হতে পারে। ঢালাওভাবে সারা দেশে একযোগে নাশকতার ঘটনা নাও ঘটতে পারে। থেমে থেমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় টার্গেট করে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নাশকতার ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। সূত্রটি জানিয়েছে, এমনকি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কোনো কোনো প্রার্থীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলা হওয়া বিচিত্র নয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জেরে এমন হামলা হতে পারে। আবার এমন দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে অন্য কোনো গোষ্ঠীও নাশকতামূলক ঘটনা ঘটনা ঘটাতে পারে। আক্রোশ থেকে মারাত্মক হামলা করে প্রতিপক্ষের টার্গেটকৃত ব্যক্তি বা প্রার্থীকে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার ঘটনা ঘটাও বিচিত্র না। কোনো প্রার্থীর কারণে কেউ নির্বাচনে হেরে গেলে জয়ী প্রার্থী গুপ্তহত্যার টার্গেটেও পরিণত হতে পারেন। এমন হামলায় মদত জোগাতে পারে দেশি-বিদেশি অনেক শক্তিও। পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, ২৯৯টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের হয়ে ১ হাজার ৫৩৪ জন এবং স্বতন্ত্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ৪৩৬ জন। সব প্রতিদ্বন্দ্বী, তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে দু'টি পৃথক তালিকা আগেই করা হয়েছে। নির্বাচনের পর জয়ীদের পৃথক তালিকা করা হয়েছে। তাদের সহযোগী হিসেবে থাকাদেরও একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায়। একইভাবে পরাজিত প্রার্থী, তাদের পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের আলাদা আলাদা তালিকা করা হয়েছে। তালিকা করা হয়েছে আসন ও থানাভিত্তিক। সূত্রটি বলছে, তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সংখ্যা ৫ হাজারের ওপরে। ক্যাটাগরি অনুযায়ী ছক করা হয়েছে। নতুন এই ছক অনুযায়ী তালিকাভুক্তদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী নিরাপত্তা নিয়ে কথা হয় পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল মামুনের সঙ্গে। তিনি অনেকটাই খোলাখুলিভাবেই নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, নির্বাচন পরবর্তী নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে অনুযায়ী একটি নতুন ছক করা হয়েছে। সেই ছকে জয়ী, পরাজিত থেকে শুরু করে তাদের পরিবার ও ঘনিষ্ঠদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। পুলিশের সব ইউনিটকে এ সংক্রান্ত ব্রিফিং ও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থাও সমন্বয় করে কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তার ইসু্যতে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। থানা পুলিশকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। এমনকি ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইউটিউবেও কেউ যদি নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আনেন, তাও গুরুত্বের দেখতে বলা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বক্ষণিক মনিটরিং চলছে। জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ নম্বরে ফোন করলেও পুলিশকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। আর যদি কেউ সশরীরে বা না গিয়ে টেলিফোনে নিরাপত্তা চান তাও দিতে প্রস্তুত আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্বাচন পরবর্তী সহিসংতা বা নাশকতার বিষয়টি মাথায় রেখেই নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে নতুন কৌশলপত্র তৈরি করা হয়েছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই পুলিশের প্রধান কাজ। এজন্য পুলিশ সর্বদা প্রস্তুত আছে। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, বিএনপি ভোটে অংশ নেয়নি। স্বাভাবিক কারণেই দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। এমনকি এটি মানুষের মধ্যেও এক ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি করে রেখেছে। অজানা আতঙ্ক থেকে প্রকৃতপক্ষে মানুষ পুরোপুরি বের হতে পারেনি। এছাড়া আগামী ১০ জানুয়ারির পর সশস্ত্র বাহিনী মাঠ ছেড়ে চলে যাবে। সেটিও একটি বিষয়। আপাতত বিএনপির নাশকতা চালানোর কোনো সম্ভাবনা নেই বলে ধারণা করছি। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে নানাভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমে সরকারকে নানাভাবে চাপে রাখার চেষ্টা করবে বিএনপি। এটিই স্বাভাবিক। এছাড়া নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন সংগ্রামে যেতে পারে। আন্দোলন সংগ্রামের আড়ালে নাশকতা, হামলা, চোরাগোপ্তা হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকান্ড চালাতে পারে। বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ যায়যায়দিনকে বলেন, নির্বাচন পরবর্তী নিরাপত্তা একটি বড় ইসু্য। এ ব্যাপারে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের যোগাযোগ সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ ইতোমধ্যেই গণমাধ্যমকে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন যত দিন চাইবে, সশস্ত্র বাহিনী সে অনুযায়ী মাঠে থাকবে বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ বলেন, এতে করে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, তা হচ্ছে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ঘটনা ঘটা বিচিত্র কিছুই না। এছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। স্বাভাবিক কারণেই দলটি তাদের সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নানা আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে চাপে রাখার চেষ্টা করবে। সেই আন্দোলন সংগ্রামের আড়ালে নাশকতা, চোরাগোপ্তা হামলা, সহিংসতা বা টার্গেট কিলিংয়ের মতো ঘটনা ঘটাও বিচিত্র না। এছাড়া বিএনপি সমমনা দলগুলোকে বিদেশি একাধিক শক্তি দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছে। স্বাভাবিক কারণেই ওইসব বিদেশি শক্তি বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামে সহযোগিতা করবে। নানাভাবে সরকারকে চাপে রাখার চেষ্টা করবে। এছাড়া কূটনৈতিকভাবেও সরকারকে নানাভাবে হেনস্তা করার সুযোগ খুঁজবে। তিনি আরও বলেন, সশস্ত্র বাহিনী মাঠে না থাকলেও দেশবাসী অনিরাপদ হয়ে যাবে, সেটি মনে করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে যেসব বাহিনী রয়েছে, সেইসব বাহিনী মাঠে থাকলে দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে কোনো সম্ভাবনা হবে না। তবে এক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সারাদেশে একযোগে নাশকতা হবে, এমনটি নাও হতে পারে। টার্গেট করে করে নাশকতা চালানো হতে পারে। বিএনপি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে পারে। সেক্ষেত্রে আগাম তথ্য থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। তবে সার্বিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগের এই অর্জন ধরে রাখতে যথেষ্ট কৌশলী ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অনুযায়ী নিরাপত্তা ছক সাজাতে হবে। অন্যথায় দেশে বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটাও বিচিত্র না। তিনি আরও বলেন, গত ২৮ অক্টোবর থেকে বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশ থেকে নাশকতার ঘটনা ঘটছে। যা অব্যাহত আছে। ভবিষ্যতেও যে এ ধারা অব্যাহত থাকবে না, তা বলা যাচ্ছে না। তবে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনে টিকে থাকতে ব্যাপকভাবে কৌশলগত পরিবর্তন আনবে। সেই কৌশল দীর্ঘমেয়াদি হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা, নাশকতাসহ নানা ইসু্যতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের সতর্ক থাকতে হবে। অন্যথায় বড় ধরনের অঘটন ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়।