যুক্তরাষ্ট্রের বার্তায় বিএনপিতে স্বস্তি
প্রকাশ | ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
হাসান মোলস্না
সরকার পতনের আন্দোলন ফের ব্যর্থ হওয়ায় বিএনপিতে চরম হাতাশা কাজ করছে। এর মধ্যে একতরফা নির্বাচনের পরও রাশিয়া, চীন ও ভারতের মতো দেশের পর্যবেক্ষরা অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সনদ দেওয়ায় দলটিকে আরও আশাহত করেছে। তবে কিছু পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে একমত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন অনিয়মের স্বীকৃতি দুঃখের মাঝে বিএনপি নেতাকর্মীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। পাশাপাশি নতুন নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এখনই কঠোর কোনো কর্মসূচিতে যাবে না তারা।
জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে ভোটের আগে বিএনপির আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো বার্তা না আশায় দলের নেতাকর্মীরা হতাশ ছিল। নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরপরই অন্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা সরব হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নীরবতা দলটির নেতাকর্মীদের বেশ ভাবিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের দুই দিন পর মঙ্গলবার পশ্চিমা পরাশক্তির দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য পৃথক বিবৃতি বিএনপি নেতাকর্মীদের বেশ চাঙ্গা করেছে। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি বলে অন্য পর্যবেক্ষকদের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একমত বলে জানানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতিতে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনে কারচুপির কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে এবং নানামুখী
\হচাপ প্রয়োগ করতে পারে। পশ্চিমারা কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, সেই পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে দলটি।
বিএনপি সূত্র মতে, বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে ভোটের অনিয়মগুলোর দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে বিএনপি। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য এবং নিজস্ব উপায়ে সংগ্রহ করা নানা তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। পরবর্তী সময় জাতিসংঘসহ বিদেশি দূতাবাসগুলোতে এই প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
দলের নেতারা মনে করেন, ভোটারবিহীন এই নির্বাচন দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাদের প্রত্যাশা, এমন ভোটের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব সোচ্চার হবে এবং তাদের পক্ষ থেকে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ প্রয়োগমূলক পদক্ষেপ আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে নতুন সরকারের টিকে থাকা কঠিন হবে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কঠোর কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি।
জানা গেছে, নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুললেও সরকারের বিরুদ্ধে আপাতত বড় ধরনের কঠোর কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে না বিএনপি। হরতাল-অবরোধের বাইরে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। একই সঙ্গে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি কয়েক দিন পর্যবেক্ষণে রাখতে চান তারা। জানা গেছে, আপাতত বড় কর্মসূচি নয়; পরিস্থিতির ওপর নজর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে সরকারকে চাপে ফেলতে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দেন কেউ কেউ। এ সময় আলোচনায় উঠে আসে, হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিলে সেটিকে ঘিরে অন্য কোনো পক্ষ নাশকতা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর এর দায় চাপিয়ে দেয়। বিএনপি সরকার বা অন্য কোনো পক্ষকে এমন সুযোগ দিতে চায় না। এ ছাড়া বিএনপির বহু নেতাকর্মী এখন কারাগারে। আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকে ঘরছাড়া, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের আগে কারামুক্ত করা দরকার। এখন কঠোর কর্মসূচিতে গেলে তাদের জামিন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে। নেতাদের ধারণা, নির্বাচন হয়ে গেছে। এখন সরকার তাদের মুক্তিতে বাধা সৃষ্টি নাও করতে পারে। সরকার বাধা না দিলে কম সময়ের মধ্যে তারা জামিনে কারামুক্ত হতে পারেন। এতে দল নতুন করে সুসংগঠিত, চাঙ্গা হবে। আন্দোলন এগিয়ে নিতে যা সহায়ক হবে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের পর বাস্তবতার নিরিখে এখন পরিস্থিতি বুঝে সামনের দিকে এগুনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দলটি মনে করছে, আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাদের আহ্বানে জনগণ সাড়া দিয়ে একতরফা ভোট বর্জন করেছে। তাদের দাবি, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ার কথা বলা হলেও মূলত ৫-১০ ভাগ ভোট পড়েছে। নির্বাচনে এই ভোটার উপস্থিতি কম হওয়াকে আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য-বিজয় হিসেবে দেখছে বিএনপি।
জানা গেছে, নির্বাচন হলেও শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন অব্যাহত রাখবে বিএনপি। নির্বাচনের ফলাফল বাতিল এবং একদফা দাবিতে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাবে দলটি। প্রাথমিকভাবে নূ্যনতম দেড় মাস কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সভা-সমাবেশসহ জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। তবে কর্মসূচির ফাঁকে মাঝেমধ্যে হরতালও দেওয়া হতে পারে।
আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচির বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর আবদুল মঈন খান বলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ দল। তাই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়েছে। জনগণের ইচ্ছায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত জবাবদিহি সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
বিএনপির সংবাদ সম্মেলন
দুর্নীতিবাজ 'ডামি সরকার' দিয়ে দেশ চলতে পারে না বলে জানিয়েছে বিএনপি। দলটি বলেছে, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল। একদলীয় একতরফা ভোটার বর্জিত ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে মূলত বিজয় হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত ভোট বর্জনকারী গণতন্ত্রকামী বীর জনতার। আর লজ্জার পরাজয় ঘটেছে গণবিচ্ছিন্ন বেপরোয়া আওয়ামী গংদের। এই দিনটি অনন্তকাল একটি জঘন্য কালো দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই দিনে দেশের সর্বস্তরের মানুষ আওয়ামী লীগকে লাল কার্ড দেখিয়েছে।
মঙ্গলবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এসব অভিযোগ করেন। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলমের আলাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার সূত্র ধরে রুহুল কবির রিজভী বলেন, গত রোববার রাতে ফলাফল ঘোষণার সময় মিডিয়ার মাইক্রোফোন অন রেখে আওয়ামী দলদাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করার সময় ফাঁস করে দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলম। সেখানে মঞ্চে পাশে বসা জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালকের সঙ্গে আলাপের সময় ইসি সচিবকে বলতে শোনা যায়, 'যেয়ে ঘুমাইয়া যামুগা। এখানে বসে থেকে লাভ আছে? সবাই রেজাল্ট জানে। ৬৪ ডিসিদের মেসেজ আছে। ৬৪টি জেলার রেজাল্ট কি হবে, সবাই জানে। পড়ে চলে যামুগা। ডিসিরা পাঠাইছে না। সব আছে। আমার কাছে আছেতো। এ সময় পাশে থাকা কর্মকর্তা ইসি সচিবের কানে কানে ফলাফল নিয়ে কিছু বলছিলেন। তখন ইসি সচিব বলেন, বিতর্কিত বানাইয়া ফালাইছে।'
রিজভী বলেন, ৭ জানুয়ারি গভীর রাত থেকে চুরি-ডাকাতি, জালভোট, শিশু কিশোর ভোট, পথিক ধরে নিয়ে ভোট, একই ব্যক্তির ৫০ ভোট, মিনিটে ৫০ ভোট, একই লাইন থেকে ঘুরেফিরে বার বার জাল ভোট দিয়েও বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোটের ঘোষণা দিয়ে গণভবনের চাপে আবার এক ঘণ্টা পরই ৪০ শতাংশ এবং গত সোমবার দুপুরে তা আরেক দফা বাড়িয়ে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোটের গোজামিলের ভৌতিক হিসাব বানানোর এই ভুয়া হাস্যকর নির্বাচন ভোটের ইতিহাসে কলঙ্ক তিলক উৎকীর্ন করল ডামি সরকার।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব এই অংশগ্রহণহীন ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি প্রদান করেছে। বিশ্বের সব মিডিয়া এবং পর্যবেক্ষকরা এই নির্বাচনকে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা এবং জনগণ ও ভোটার সম্পর্কহীন পুরোপুরি 'ওয়ান উয়েম্যান শো'-এর ঘোষিত জয়-পরাজয়ের ভোট বলে আখ্যায়িত করেছে।
রিজভী বলেন, পাতানো ডামি নির্বাচনের ফাঁদে পা দেয়নি দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ। সারাদেশের ভোট কেন্দ্রগুলো ছিল ভোটারশূন্য। এই প্রহসনমূলক নির্বাচন দেশকে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসা ব্রিটিশ পর্যবেক্ষক জেজ কৌলসন সাংবাদিকদের বলেছেন, আই ফাউন্ড দ্য নর্থ কোরিয়া মডেল হিয়া'র। বাংলাদেশে উত্তর কোরিয়া স্টাইলের একদলীয় নির্বাচন হয়েছে।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, জনগণ বিএনপির কাছ থেকেই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনের নেতৃত্ব আশা করে। সুতরাং, প্রত্যেকে সাংগঠনিক এলাকায় গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিন। সরকারের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।