৭ জানুয়ারির ভোট সুষ্ঠু হয়নি :যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য

প্রকাশ | ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

বিবিসি বাংলা
বাংলাদেশে সাতই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন 'অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মানদন্ড' মেনে অনুষ্ঠিত হয়নি বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রায় দুইদিন পর পশ্চিমা পরাশক্তির দেশ দুটি এ নিয়ে পৃথক বিবৃতি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সোমবার অর্থাৎ আটই জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়। একইদিনে যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও)ও পৃথক বিবৃতি দেয়। নির্বাচনের আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমের কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ নির্বাচন করার জন্য তাগিদ দিয়ে আসছিল। যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র : যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টেমন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কার্যালয় থেকে ইসু্য করা বিবৃতির শিরোনাম ছিল 'পার্লামেন্টারি ইলেকশনস ইন বাংলাদেশ'। প্রায় একই বক্তব্য নিয়ে মিলার সামাজিক মাধ্যম এক্সেও (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট দিয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে। ম্যাথিউ মিলারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ্য করেছে সাতই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী-লীগ সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন নিয়ে জয়ী হয়েছে। তবে, হাজারো বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনের দিনে বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের অনিয়মের খবরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। সেই সঙ্গে, বাংলাদেশের এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি বলে অন্য পর্যবেক্ষকদের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একমত বলে জানানো হয় বিবৃতিতে। এছাড়া নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করায় হতাশা প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময় এবং এর আগের মাসগুলোতে বাংলাদেশে যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। সহিংসতার ঘটনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে সব দলের প্রতি সহিংসতা পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটন। তবে, সামনের দিনে, বাংলাদেশের সঙ্গে একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল গঠন, মানবাধিকার এবং বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী বলে বিবৃতিতে উলেস্নখ করা হয়েছে। আর দুই দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নেও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কথা জানানো হয়। যুক্তরাজ্যের প্রতিক্রিয়া যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) বা দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে সাতই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলের প্রতি দৃষ্টি রেখেছিল। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'গণতান্ত্রিক নির্বাচন নির্ভর করে বিশ্বাসযোগ্য, মুক্ত ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার ওপর। মানবাধিকার, আইনের শাসন ও যথাযথ প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অপরিহার্য উপাদান। নির্বাচনের সময় এসব মানদন্ড ধারাবাহিকভাবে মেনে চলা হয়নি।' নির্বাচনের আগে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বহু সংখ্যক কর্মী গ্রেপ্তার ও নির্যাতন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্যও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে নির্বাচনের প্রচারণার সময় সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শনমূলক কর্মকান্ডের নিন্দা জানিয়েছে। এছাড়া নির্বাচনে সব দল অংশ না নেয়ায় বাংলাদেশের মানুষের হাতে ভোট দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিকল্প ছিল না বলে মতামত দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে। তবে, যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে উলেস্নখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একটি টেকসই রাজনৈতিক সমঝোতা ও সক্রিয় নাগরিক সমাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি নিজেদের মতপার্থক্য দূর করে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। আর এ প্রক্রিয়ায় সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান যা বলছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার টার্ক এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার এবং আটকাবস্থায় মৃতু্যর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন। তিনি প্রকৃত 'অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রে'র জন্য সরকারকে 'গতিপথ পরিবর্তন করার' আহবান জানিয়েছেন। সোমবার দেওয়া এক বিবৃতিতে টার্ক নবনির্বাচিত সরকারকে দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রম্নতি পূরণে পদক্ষেপ নিতে আহবান জানান। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান বলেছেন, '২৮ অক্টোবর পর্যন্ত বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাসহ প্রায় ২৫ হাজারের মতো কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। গত দুই মাসে অন্তত ১০ জন বিরোধী দলের সমর্থক জেল কাস্টডিতে মারা গেছে বা খুন হয়েছে।' 'অনেক মানবাধিকার কর্মী আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছেন, কেউ কেউ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন, যেখানে নভেম্বরেই বেশিরভাগ সন্দেহভাজন জোরপূর্বক গুমের ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছে।' বিবৃতিতে মি. টার্ক বলেছেন, 'এসব ঘটনার স্বাধীন তদন্ত হওয়া উচিত এবং যারা জড়িত তাদের অবশ্যই স্বচ্ছ এবং ন্যায় বিচারের আওতায় আনতে হবে।' বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন পক্ষ বিভিন্ন সময় মতামত প্রকাশ করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধ, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং স্বাধীন মত প্রকাশে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে যুক্তরাজ্যকে সাধারণত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইসু্য বা নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি কাছাকাছি সময়ে। এদিকে, সোমবার ঢাকায় কানাডিয়ান হাইকমিশন এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, সাতই জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠানো হয়নি। তারা বলছে, পর্যবেক্ষক হিসেবে চিহ্নিত কানাডার দু'জন নাগরিক 'স্বতন্ত্রভাবে' নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। কাজেই নির্বাচন নিয়ে তাদের দেওয়া মতামতের সঙ্গে কানাডা সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। উলেস্নখ্য যে, ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ শেষে সন্ধ্যায় ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করেন বিদেশি পর্যবেক্ষকদের একটি দল। এতে চন্দ্রকান্ত আর্য এবং ভিক্টর ওহ নামে কানাডার দু'জন নাগরিক অংশ নেন। তখন 'ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে' বলে সাংবাদিকদের জানান আর্য। তার এই মন্তব্য যে কানাডা সরকারের বক্তব্য নয়, ফেসবুক পোস্টে সেটাই পরিষ্কার করে বিবৃতি দিল কানাডা হাইকমিশন।