এ বিজয় জনগণের
গণভবনে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা
প্রকাশ | ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নয়, জনগণের জয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার ভোট পর্যবেক্ষণে আসা বিদেশি ও সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তিনি এসব কথা বলেন।
গণভবনের এই মতবিনিময়ে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, 'এবারে নির্বাচনে জনগণ যে ভোট দিয়েছে, নির্বাচিত করেছে এবং আমাদের অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীও নির্বাচিত হয়েছেন। অন্য দলেরও বেশকিছু নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। এই দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য সব ব্যবস্থা নিয়েছে। এ বিজয়টা হচ্ছে জনগণের বিজয়। এ বিজয়টা আমার বিজয় না।'
জনগণের সরকার গঠন করবার অধিকার ও ক্ষমতা আছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'যেটা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছি জনগণের ভোটের অধিকার সেটা তারা নিজেরা প্রয়োগ করবে সেটা সুষ্ঠুভাবে হয়েছে।'
রোববারের ভোট দেখতে আসায় বিদেশিদের ধন্যবাদও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, আমাদের দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এটা অত্যন্ত যুগান্তকারী ঘটনা।'
তিনি বলেন, 'নির্বাচনটা যে অবাধ, সুষ্ঠু হতে পারে সেই দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পেরেছি।
আপনাদের আগমন আমাদের দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের অধিকারটা আরও সুরক্ষিত হয়েছে। আপনারা যার যার দেশে ফিরে যাবেন, বাংলাদেশের কথা বলবেন। আপনাদের আগমন আমাদের গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থাকে আরও মজবুত ও শক্তিশালী করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।'
শেখ হাসিনা মনে করেন, ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি ছিল না। তিনি বলেন, 'আমি অনেকবারই নির্বাচন করেছি। সেই ১৯৮৬ সাল থেকে আটবারই আমার নির্বাচন করা হয়ে গেছে। তবে এত মানুষের আগ্রহ আগে দেখিনি।'
'আমি মনে করি, বাংলাদেশের জনগণ অনেক আনন্দিত এবং নির্বাচন যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন, মতামত দিয়েছেন সেটা উপযোগী। সেই জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।'
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের ফলাফলের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের সবসময় এটাই চেষ্টা ছিল নির্বাচনটাকে সুষ্ঠু করা। মানুষের যে ভোটের অধিকারটা অর্থাৎ সে যাকে চায়, কে সরকারে থাকবে, সেটা মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে। সেই জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থাকে সংস্কার করেছি।'
তিনি বলেন, 'নির্বাচন চলাকালীন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সবাইকে নির্বাচন কমিশনের অধীন করে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা- সেটাই লক্ষ্য ছিল।'
নির্বাচনটাকে 'ব্যতিক্রমী' উলেস্নখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'সাধারণত আমরা দলের প্রার্থী ঠিক করে দিই বা সব দল তাদের প্রার্থী নির্বাচন করে দেয়। এবার আমরা আমাদের প্রার্থী নির্বাচিত করেছি, পাশাপাশি এ নির্বাচনটা উন্মুক্ত করে দিয়েছি, যে যার ইচ্ছামতো দাঁড়াতে পারবে।'
নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে শেখ হাসিনা বলেন, 'নির্বাচন হয়ে গেছে, এখনো গেজেট হয়নি। তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'গেজেটের পর শপথ হবে, এরপর আমাদের সংসদীয় দলের বৈঠক করতে হবে। সেখানে সংসদীয় দলের নেতা কে হবে সেটা নির্বাচন করতে হবে। তখন সরকার গঠন করতে রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে হবে। সরকার গঠন হবে। এটাই সংবিধানিক প্রক্রিয়া, আর তা অনুযায়ী করতে চাচ্ছি।'
বিএনপির ভোট বর্জন প্রসঙ্গ
বিএনপির ভোট বর্জন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোনো দল যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তার মানে এই নয় যে দেশে গণতন্ত্র নেই।
নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে বিবিসির সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, 'আপনি প্রধান বিরোধী দলকে ২০১৮ সালের পর থেকে সংলাপে অন্তর্ভুক্ত করেননি। তাদের অনুপস্থিতিতে গতকালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। যেখানে ৬০ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়নি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সীমিত করা হয়েছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা আপনার সরকারের সমালোচনা করছেন। আপনি কি বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশে একটি গতিশীল গণতন্ত্র থাকবে, যেখানে কোনো বিরোধী দল নেই?
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'প্রতিটি দলের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। সেখানে যদি কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নেয়, তার মানে এই না যে গণতন্ত্র নেই। আপনাকে বিবেচনা করতে হবে মানুষ অংশ নিয়েছে কিনা। আপনি যে দলের (বিএনপি) কথা বলেছেন তারা আগুন দেয়, মানুষ হত্যা করে। কিছু দিন আগে ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ মেরেছে। এটা কি গণতন্ত্র? এটা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। মানুষ এটা গ্রহণ করে না। এ ধরনের ঘটনা এ দেশে একাধিকবার ঘটেছে। আমরা ধৈর্য দেখিয়েছি। মানুষের অধিকারকে রক্ষা করতে হবে।'
বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন এবং অর্ধেকের কম ভোট পড়া নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'যদি এখানে গণতন্ত্রের আর কোনো সংজ্ঞা থাকে সেটা ভিন্ন। মানুষের অংশগ্রহণই বড় কথা।'
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিএনপি মানুষকে এ নির্বাচনে ভোট না দিতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মানুষ তাদের কথা শোনেনি।
প্রধানমন্ত্রী বিবিসির সাংবাদিককে পাল্টা বলেন, বিএনপি কত মানুষ মেরেছে সে প্রশ্ন তিনি করেননি। তারা ২০১৪-১৫ সালে যা করেছে তাতে তাদের কীভাবে গণতান্ত্রিক দল বলা যায়? তারা সন্ত্রাসী দল এবং মানুষ তাদের সমর্থন করে না।
ভারতের টেলিগ্রাফের এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, 'নির্বাচন শেষ হয়েছে। আপনি যখন গণতন্ত্রের কথা বলছেন, তখন আপনার বিরোধী দলের প্রয়োজন হবে। এ ব্যাপারে আপনি কি ভাবছেন?'
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, 'আপনি কি চান আমি একটি বিরোধী দল গঠন করি? আমি তা করতে পারি? আমি নিজেও বিরোধী দলে ছিলাম দীর্ঘ সময়। আমরা আমাদের দল গঠন করেছি। বিরোধীদেরও তা করতে হবে। আপনি যদি তা করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার জন্য কে দায়ী?'
ড. ইউনূস প্রসঙ্গ
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিনি শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছেন। তার কোম্পানির শ্রমিকরাই তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এখানে তার কিছুই করার নেই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমা করা হবে কিনা, এক বিদেশি সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'দেখুন... ইউনূসের বিষয়টি শ্রম আদালতের বিষয়। তিনি শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছেন। তিনি শ্রমিকদের ঠকিয়েছেন। এখানে আমার কোনো কিছুই করার নেই।'
গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দল থাকাটা জরুরি কিনা, আরেক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমিও বিরোধী দলে ছিলাম দীর্ঘদিন। সে সময় আমরা দলকে সংগঠিত করেছি। এক্ষেত্রে বিরোধী দলকে তাদের নিজেদের সংগঠিত করতে হবে। আমাকে বিরোধী দল গঠন করতে বলতে পারেন না। অবশ্য আমি সেটি চাইলেও পারি। কিন্তু তখন সেটি আর বিরোধী দল থাকবে না।'
এ সময় বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, তারা নির্বাচনে অংশ নিতে চায়নি। তারা মানুষের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া ঠেকাতে চেয়েছে। কিন্তু তারা সেটি পারেনি। কারণ মানুষ সচেতন।
প্রকৃতিগতভাবেই বাংলাদেশের মানুষ স্মার্ট
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রকৃতিগতভাবেই বাংলাদেশের মানুষ স্মার্ট। তারপরও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য তাদের আরও স্মার্ট করে তোলার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ সময় শেখ হাসিনাকে ইন্ডিয়ান প্রেস ক্লাবের সভাপতি গৌতম লাহিড়ী তাদের সদস্যদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, 'আমরা ইন্ডিয়ান প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু মিডিয়া সেন্টার স্থাপন করেছি। আপনাকে সেখানে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচনে আপনি জয়লাভ করেছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো অর্জন। আপনি বলেছেন, বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবেন। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য সুশাসন নিশ্চিত করতে কী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন?'
এ প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'প্রকৃতিগতভাবেই আমাদের দেশের মানুষ স্মার্ট। তবে আমরা তরুণ প্রজন্মকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করছি। কেননা, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশে পৌঁছানোর লক্ষ্য আমাদের রয়েছে। দেশের উন্নয়ন করতেই আমাদের তরুণ প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দিতে চাই।'
শেখ হাসিনা বলেন, 'স্মার্ট জনগোষ্ঠী, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এগুলো জনগণের সহযোগিতায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সেজন্য আমরা তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাই। আমি বলতে চাই, আমাদের মূল সম্পদই হলো জনসাধারণ। সেজন্য তাদের স্মার্ট বাংলাদেশের উপযোগী করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।'