ঢাকা-৬ আসনের নির্বাচন একাই জমিয়ে দিয়েছেন ঢাকার সিটি কাপোরেশনের সাবেক মেয়র ও নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তার সামনে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে বিরামহীন প্রচারণা চালাচ্ছেন। যাচ্ছেন ভোটারদের ঘরে ঘরে। সেই সঙ্গে চলছে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা। মিছিলে, সেস্নাগানে সেস্নাগানে আসনটির পুরো এলাকা রীতিমতো সরগরম। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী অপর ছয় প্রার্থীদের তেমন কোনো প্রচার প্রচারণা বা সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি।
সরেজমিনে আসনটির অধীন গেন্ডারিয়ার কেশব ব্যানার্জি (কেবি) রোড, আলমগঞ্জ রোড, সতীশ সরকার রোড, মতিঝিল লাগোয়া টিকাটুলি, হাটখোলা, ওয়ারী, স্বামীবাগ, নারিন্দা, শরৎগুপ্ত রোড, বেগমগঞ্জ, দয়াগঞ্জ, ধোলাইখাল, সূত্রাপুর, লক্ষ্ণীবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা সরেজিমন ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় রীতিমতো ভোট উৎসব চলছে। যেন ঈদ বা পূজা পার্বণের আনন্দ বিরাজ করছে। আসনটির প্রতিটি এলাকা নৌকা প্রতীকের ব্যানার আর পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে। পোস্টার লাগানোর আর কোন জায়গাও নেই। মাঝে মধ্যে অবশ্য অনান্য প্রতীকের পোস্টার চোখে পড়েছে। তবে তা একেবারেই কম।
দেখা গেছে, প্রতিটি পাড়ায় মহলস্নায় মহলস্নায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প। ক্যাম্পগুলোতে চলছে জম্পেস আড্ডা। একেক ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ করছেন একেক বয়সি লোকজন। কোন ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে মুরুব্বিদের
\হকাছে। আবার কোন কোনটি নিয়ন্ত্রণ করছেন মাঝ বয়সিরা। আর বাদ বাকি ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় যুবক ও তরুণরা।
সকাল ১০টা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত ক্যাম্পে আড্ডা চলে। বেলা ১১টার দিকে প্রথম দফার আড্ডা জমে। এরপর দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর পুরনো ঢাকার বাসিন্দাদের অনেকেই ভাত ঘুম দেন। এরপর শুরু হয় বিকালের ম্যারাথন আড্ডা। সেই আড্ডায় বাড়তি আনন্দ দেয় পুরনো ঢাকার ঐহিত্যবাহী বাকরখানির সঙ্গে চা।
ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করে দেখা যায়, চলছে চা, কফি, লেমন টি (লেবু চা) পানের ধুম। কেউ বা আবার আদা লেবু ও মসলস্না চা পান করছেন। চা কফি পানের পরেই অনেকেই আবার আয়েস করে পুরান ঢাকার মসলস্না পান বা মিষ্টি চিবাচ্ছেন। আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই চা বা কফি পান করছেন। এমন অবস্থা চলছে সকাল থেকে নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত। যেন রীতিমতো ভোট উৎসব চলছে।
বয়স্কদের অনেকেই বিভিন্ন নির্বাচনী ক্যাম্পে বসে সবার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। আবার সমবয়সিরাও ভিড় করছেন। নানা ভাগে চলছে আড্ডা। কোন কোন নির্বাচনী ক্যাম্পে চলছে মুরুব্বিদের আড্ডা। আবার কোনটিতে চলছে মাঝ বয়সিসহ তরুণদের আড্ডা। আবার কোনটিতে চলছে কিশোর ও যুবকদের আড্ডা। পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকা যেন ভোট উৎসবকে ঘিরে রীতিমতো আড্ডায় মেতেছে। এছাড়া নির্বাচনে মাঠে সেনাবাহিনী ও বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি সদস্য মোতায়েন থাকায় বয়স্কদের আড্ডার মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ বেশি। তারা নির্ভয়ে আড্ডা দিচ্ছেন।
এই প্রতিবেদকও নিয়েছিলেন পুরান ঢাকার বংশালের ডেসকো অফিসের তিন রাস্তার মোড়ের নৌকা প্রতীকের নির্বাচনী ক্যাম্পের আড্ডায়। আড্ডার ছলে কথা হচ্ছিল মুরুব্বি ভোটারদের সঙ্গে। তারা বলছিলেন, আসনটিতে গত ১০টি বছর আওয়ামী লীগের কোন এমপি ছিলেন না। দীর্ঘদিন পর আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েছেন। এটি আমাদের জন্য অবশ্যই ভাল খবর। সবচেয়ে বড় কথা সাঈদ খোকন আমাদের সন্তান। পুরান ঢাকার পোলা। তাইতো একেবারে প্রাণ খুলে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন। তারা বয়সের কারণে নির্বাচনী প্রচারণায় যেতে পারেননি। তবে বয়স থাকলে ঠিকই যেতেন। ঢাকার প্রথম নির্বাচিত প্রয়াত মেয়র হানিফ সাহেবের ছেলে বলে কথা। মেয়র থাকা অবস্থায় তার কিছু ভুলত্রম্নটি হয়েছে। ছোট মানুষ সেটি হতেই পারে। আর প্রথমবার জনপ্রতিনিধি হয়েছিল, তাই হয়তো সবকিছু ঠিকঠাক মত করতে পারেনি। এবার আশা করছেন সবকিছু ভাল ভাবে করতে পারবে। অভিজ্ঞতা বলতে একটা কথা আছে না। এতদিন রাজনীতি করে নিশ্চয়ই অনেক কিছু শিখেছে।
হাজি আজগর বংশালের বাসিন্দা তিনি বলছিলেন, 'সাঈদ খোকনকে আমরা অনেক ছোট দেখেছি। আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে। মেয়র থাকা অবস্থায় তার একটি উদ্যোগ খুবই ভালো ছিল। সেটি হচ্ছে পুরান ঢাকার রাস্তা বড় করার উদ্যোগ। বহু বাধা বিপত্তি পেরিয়ে অনেক রাস্তা বড় করতে সক্ষম হয়েছে। এই যে যেখানে বসে আছি, সেখানে ময়লা ফেলার জায়গা ছিল। কি সুন্দর দৃষ্টিনন্দন পার্ক করেছে। ভেতরে সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। হাজার হলেও পুরান ঢাকার ছেলে এবং এখানকার মায়া বলে কথা। শুধু বংশাল নয় আশপাশের সব কবরস্থান পাকা করে দেয়াল তুলে দিয়েছে। মোকিম বাজারের ভেতরের রাস্তা দেখলে চেনা যায় না। এক সময় একটি ছোট পিক ঢুকলে আর কোন গাড়ি যাতায়াত করতে পারত না। সেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এখন অনায়াসে দু'টি গাড়ি ক্রস করতে পারে। লক্ষ্ণীবাজার মোড়ে তিন রাস্তার পাশে ফুটওভার ব্রিজ করেছে। অথচ সেখান দিয়ে এক সময় হেঁটে যাওয়া যেত না। তবে এখনো অনেক রাস্তা খারাপ আছে। সেগুলো ঠিক হয়ে যাবে।'
ধোলাইখালের হৃষিকেশ দাস রোডের বাসিন্দা ও ভোটার সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের গণিতের শিক্ষক মিহির বলছিলেন, 'ধোলাইখালে এক সময় যাওয়া যেত না। একেবারেই সরু রাস্তা ছিল। সেই রাস্তা ভেঙে বড় করেছেন। এখন অনায়াসে ধোলাইখালের মতো জায়গায় যানজট হয় না বললেই চলে। যার সুবিধা ভোগ করছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দাসহ এসব এলাকায় যাতায়াতকারী প্রতিটি মানুষ।'
হরিচরণ রোডের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজি আবুল হাশেমের ছেলে ব্যবসায়ী অলো হোসেনের দাবি, 'হরিচরণ রোডে এক সময় দু'টি রিকশা ক্রস করতে পারত না। এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে দু'টি গাড়ি ক্রস করতে পারে। যা সত্যিই অভাবনীয়। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় আসনটিতে সাঈদ খোকনের তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই। এছাড়া পুরান ঢাকার ছেলে বলে কথা। আসনটির অন্তত ৮০ ভাগ ভোটার স্থায়ী বাসিন্দা। এমনকি আসনটির ভোটারদের মধ্যে অন্তত ৮০ ভাগ ভোটারই ভোট দিতে যাবেন।'
ভোটার অলো আরও বলেন, বিশেষ করে দশ বছর পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়ে মানুষের মধ্যে রীতিমতো আনন্দের জোয়ার বইছে। আসনটিতে ঢাকার সব আসনের চেয়ে সবচেয়ে বেশি ভোটার ভোট প্রয়োগ করবেন। এমনকি নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। তার বিকল্প কোনো প্রার্থীই নেই। এছাড়া আসনটিতে সনাতন ধর্মালম্বীদের প্রচুর ভোট রয়েছে। আসনটিতে আওয়ামী লীগের ভোটারের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
সরেজমিনে ডিস্টিলারি রোডের পূর্ব দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গবেষণাগারসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এলাকাটিতে উৎসব চলছে। ঈদ ও পূজাপার্বনে এমন আনন্দ দেখা যায় এলাকাটিতে। সেখানকার বেশ কয়েকটি হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাই অর্ডার ফেরত দিতে হচ্ছে। এত চাহিদা। সকালে গরু বা খাসির পায়ার নেহারির সঙ্গে পাতলা নান রুটি দিয়ে নাশতা। এছাড়া পরোটা চলছে মুড়ি-মুড়কির মতো।
দুপুরে পুরনো ঢাকার ঐহিত্যবাহী কাচ্চি বিরিয়ানি। হানিফ বিরিয়ানির দোকানে যেন তিল ধারণের জায়গা নেই। হাজী বিরিয়ানিতে তো টোকেন সংগ্রহ করে বিরিয়ানি নিতে দেখা গেছে অনেককেই। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, অন্তত একদিন আগে টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। তারপর সিরিয়াল অনুযায়ী বিরিয়ানি সরবরাহ করা হয়। নির্বাচনের অন্তত সাত দিনে পরেও এমন চাপ থাকবে বলে জানিয়েছেন বিরিয়ানি খেতে আসা ভোটাররা। পুরনো ঢাকার প্রতিটি হোটেলে আকার ভেদে গড়ে অন্তত ৫ থেকে ১০ জন করে বাড়তি কারিগর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারপরেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। বিকালে পাতলা নানের সঙ্গে চলছে কাবাব, পরোটা, মুগলাই, ফালুদা, জুস, কোমল পানীয়, হালিমসহ পুরান ঢাকার নানা ঐতিহ্যবাহী খাবার।
ভোটাররা জানান, দীর্ঘ ১০ বছর পর আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়ায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সাঈদ খোকন রীতিমতো পুরো চষে বেড়াচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, আইপি টিভি চলছে নির্বাচনী প্রচারণা। সেই সঙ্গে সশরীরে ভোটারদের দোয়ারে দোয়ারে যাওয়ায় ভোটারদের মন কেড়েছেন তিনি।
আসনটিতে আরও ছয়জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যার মধ্যে রয়েছেন সোনালি আঁশ প্রতীকে নির্বাচন করছেন তৃণমূল বিএনপির কাজি সিরাজুল ইসলাম। বাইকেল প্রতীকে নির্বাচন করছেন জেপির (জাতীয় পার্টি) সৈয়দ নাজমুল হুদা। মিনার মার্কা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইসলামী ঐক্য জোটের মো. রবিউল আলম মজুমদার। আম প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) আবু হামিদুর রেজা খান ভাসানী। ছড়ি প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মুক্তি জোটের মো. আকতার হোসেন ও মাছ প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে রয়েছেন গণফ্রন্টের মো. আমিনুল ইসলাম সরকার।
প্রসঙ্গত, পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, ওয়ারী, গেন্ডারিয়া থানার পুরো অংশ, কোতোয়ালি ও বংশাল থানার একাংশ নিয়ে গঠিত আসনটি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৪, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫ ও ৪৬ নম্বর মোট ১১টি ওয়ার্ড নিয়ে আসনটি গঠিত। আসনটিতে ভোটারের সংখ্যা ২ লাখ ৬৯ হাজার ২৭৬ জন। আসনটিতে তৃতীয় লিঙ্গের কোনো ভোটার নেই। যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৪৩ হাজার ৮০ জন ও নারী ভোটার ১ লাখ ২৬ হাজার ১৯৬ জন।