শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১
তৈরি পোশাক খাত

বিকল্প বাজারে উদ্যোক্তাদের আশা

অপ্রচলিত ১৮ দেশে যাচ্ছে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ায় সরাসরি অর্ডার পাচ্ছে ১৬শ' কারখানা
বীরেন মুখার্জী
  ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বিকল্প বাজারে উদ্যোক্তাদের আশা

দেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো। এর মধ্যে একক দেশ হিসেবে শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রম অধিকার রক্ষা, নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইসু্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের এক ধরনের টানাপোড়েনের মধ্যে বড় বাজারগুলোতে পোশাক পণ্যের রপ্তানি কিছুটা কমেছে। এতে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে উদ্যোক্তাদের মাঝে। তাদের মতে, বাজারের এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে এখাত থেকে রপ্তানি আয় কমতে পারে। তবে নানা শঙ্কার মধ্যেও অপ্রচলিত বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। বিশ্বের ১৮ দেশে রপ্তানি হচ্ছে তৈরি পোশাক। সরকারের পক্ষ থেকে রপ্তানিতে ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য বিকল্প এই বাজার উদ্যোক্তাদের মাঝে আশা জাগাচ্ছে।

রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ইউরোপীয় সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) যে পরিমাণ পোশাক পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, তা গত অর্থবছরের একই সময়ের (প্রথম পাঁচ মাস) তুলনায় শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ কম। বৈশ্বিক নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি বাড়ছে। রপ্তানিকারকদের আস্থাও বাড়ছে এসব দেশে। উদ্যোক্তাদের নানা উদ্যোগ ও রপ্তানিতে সরকারের নগদ সহায়তা অপ্রচলিত বাজার সম্প্রসারণে উৎসাহ জোগাচ্ছে। ফলে দেশীয় পোশাক পণ্যের রপ্তানি মন্দার বাজারে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে পোশাকের এই বিকল্প বাজার।

তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ বলছে, বর্তমানে দেশের

প্রচলিত ও প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। এসব বাজারে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বেশি। এসব বাজারের বাইরের দেশগুলোকে অপ্রচলিত বা নতুন বাজার হিসেবে দেখা হয়। অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চীন, রাশিয়া, আরব আমিরাত, কোরিয়া ও ভারতে রপ্তানি বেশি।

উদ্যোক্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরই বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। তবে চীন এখন অনেক বাজার থেকে সরে এসেছে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা সেসব বাজারে আস্থা অর্জন করছে। জাপান থেকে সরে গেছে চীন। সেখানে যে গ্যাপ তৈরি হয়েছে সেটা পূরণের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। এভাবে সুযোগ তৈরি হচ্ছে অপ্রচলিত বাজারে। রপ্তানিও বাড়ছে, আগামীতে আরও বাড়বে।

অপ্রচলিত যে ১৮টি দেশে বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম জাপান। জাপানে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি বেড়েছে ৩৯ শতাংশেরও বেশি। অপ্রচলিত দ্বিতীয় প্রধান বাজার অস্ট্রেলিয়া। যেখানে রপ্তানি বাড়ছে জাপানের চেয়েও বেশি। অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি বেড়েছে ৫৪ শতাংশ হারে। অপ্রচলিত এ বাজারেও ধারাবাহিকতা রয়েছে রপ্তানিতে। আলোচিত সময়ে দেশটিতে মোট ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তবে, অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে ভারতে গত প্রান্তিকে রপ্তানি ৮ শতাংশ কমেছে। ভারতের বাজারে ২৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল মনে করছেন, বৈশ্বিকভাবে ২০২৩ সাল পোশাক খাতের জন্য ২০২২ সালের মতো এতটা ভালো ছিল না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডবিস্নউটিও) তথ্যের বরাতে তিনি বলেন, 'সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে বৈশ্বিকভাবে মোট পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৭৬ বিলিয়ন ডলারের। ২০২৩ সালে তা কিছুটা কমেছে। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারগুলো পোশাকের ক্রয়াদেশ বা আমদানি কমিয়েছে।'

তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে ইউরোপের দেশগুলোয় রপ্তানি হয়েছে ৯০৫ কোটি ডলারের পোশাক পণ্য, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে (প্রথম পাঁচ মাস) ছিল ৯০৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ, এ সময়ে ইইউভুক্ত দেশসমূহে পোশাকের মোট রপ্তানি আয় ৪৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ থেকে ৪৭ শতাংশে নেমেছে।

এরমধ্যে অন্যতম বৃহৎ বাজার জার্মানিতে গত পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রপ্তানি কমেছে ১৫ শতাংশ। দেশটিতে আলোচিত সময়ে বাংলাদেশের পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২৩১ কোটি ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৭২ কোটি ডলার। এ হিসেবে রপ্তানি কমেছে ৪১ কোটি ডলারের। যুক্তরাষ্ট্রে গত পাঁচ মাসে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। দেশটিতে গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩৪৮ কোটি ডলারের পোশাক বিক্রি হলেও চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা ৩২৮ কোটি ডলারে নেমেছে। এ হিসাবে মার্কিন মুলুকে রপ্তানি কমেছে ২০ কোটি ডলারের।

পোশাক রপ্তানির এ অবনমনকে উদ্বেগের জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সম্প্রতি একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'পোশাক রপ্তানির সিংহভাগই আসে প্রচলিত বড় বড় বাজার থেকে। এসব বাজারে রপ্তানি কমে আসা উদ্বেগের। তবে নতুন তথা অপ্রচলিত বাজারে ধীরে ধীরে রপ্তানি বৃদ্ধি দেশের পোশাকশিল্পের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত।'

তিনি বলেন, 'বিজিএমইএতে আমরা দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই পোশাক পণ্যের রপ্তানিতে নতুন তথা বিকল্প বাজার তৈরিতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছি। আমরা সেভাবেই কাজ করেছি। কূটনৈতিকভাবেও নানান সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পোশাকের ব্র্যান্ডিং করেছি। কিন্তু প্রচলিত বাজারে রপ্তানি কমে যাওয়া ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তা রপ্তানি খাতের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং শ্রম অধিকার রক্ষার ইসু্যতে নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা আগামী দিনে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রভাব ফেলবে কি না, তা নিয়ে রপ্তানিকারকদের উদ্বেগ রয়েছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ।'

বিজিএমইএ'র তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে পোশাক শিল্পখাত থেকে। দেশে প্রায় ৬ হাজার ৮৮৫টি পোশাক কারখানা সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ করলেও ৩ হাজার ৯৬৪টি সদস্য কারখানা বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। অবশিষ্ট ২ হাজার ৩৩৯টি কারখানা বিজিএমইএতে তাদের সদস্যপদ নবায়ন করেছে। এর মধ্যে মাত্র ১৬শ' কারখানা ক্রেতাদের কাছ থেকে সরাসরি অর্ডার এনে কাজ করছে। বাকিরা দেনা ও দায়ের কারণে সরাসরি ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলতে পারছে না। তারা সাব-কন্টাক্টে কাজ করে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দেশের অর্থনীতির গতিশীলতা ধরে রাখতে তৈরি পোশাক খাতের ওপর অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। অপ্রচলিত বাজার ধরে রাখতে বিদ্যমান সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি আরও নতুন নতুন দেশে কীভাবে রপ্তানি বাড়ানো যায় সে বিষয়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের ভূমিকা রয়েছে। সম্মিলিত প্রয়াসই এ খাতের সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে