লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মঙ্গলবার রাতে ইসরাইলের ড্রোন হামলায় হামাসের উপপ্রধান সালেহ আল আরোরি নিহত হয়েছেন। এ হামলায় হামাসের সামরিক শাখা কাসেম ব্রিগেডের দু'জন কমান্ডারও নিহত হয়েছেন।
হামাস জানিয়েছে, বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপশহর দাহিয়ে তাদের কার্যালয়ে বিস্ফোরণে সাতজন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে উপপ্রধান সালেহ আল-আরোরিসহ ওই তিনজন রয়েছেন।
সালেহ আল-আরোরি হামাসের রাজনৈতিক বু্যরোর উপপ্রধান। তিনি এই গোষ্ঠীর সামরিক কর্মকান্ডেও গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই হত্যাকান্ডের নিন্দা জানিয়েছেন হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়ে। এক বিবৃতিতে ইসরাইলের হামলাকে কাপুরুষোচিত আখ্যায়িত করে তিনি বলেছেন, ইসরাইল লেবাননের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে ও চলমান সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
হামলার নিন্দা জানিয়েছে ইরান। লেবানন ইসরাইলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অভিযোগ করার ঘোষণা দিয়েছে।
হামলার পর লেবাননের শিয়াপন্থিগোষ্ঠী হিজবুলস্নাহ এক বিবৃতিতে বলেছে, বৈরুত শহরের কেন্দ্রস্থলে সালেহ আল-আরোরি ও তার সঙ্গীদের হত্যার অপরাধকে লেবানন এবং এর জনগণ নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরোধের বিরুদ্ধে একটি বিপজ্জনক আগ্রাসন বলে মনে করে। এই অপরাধের জন্য 'প্রতিক্রিয়া ও সাজার' মুখোমুখি হতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে গোষ্ঠীটি।
ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী
মোহাম্মদ শাতায়েহ হামাস উপপ্রধান সালেহ আল-আরোরি হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি এই হত্যাকান্ডকে 'পরিচিত অপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ' বলে অভিহিত করেছেন।
ইসরাইলের সেনাবাহিনী এই হামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেছেন, যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তার দেশের বাহিনীগুলো প্রস্তুত রয়েছে।
কে এই সালেহ আল-আরোরি
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামাসের রাজনৈতিক বু্যরোর উপপ্রধান সালেহ আল-আরোরির বয়স ৫৭ বছর। তিনি হামাসের সামরিক শাখা কাসেম ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি হামাসে যোগ দিয়ে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। পশ্চিম তীরে গোষ্ঠীটির সামরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন তিনি। ২০১১ সালে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন কর্পোরালকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে এক হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। ওই চুক্তির সঙ্গে জড়িত ছিলেন আল-আরোরি। ইরান ও লেবাননের হিজবুলস্নাহ গোষ্ঠীর সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ ছিল।
এই হত্যার পরিণতি কী হতে পারে
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে বলা হয়, কয়েক মাস ধরেই ইসরাইলি কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন, বিদেশে থাকা হামাস নেতাদের হত্যা করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের গত ৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরাইল-ঘোষিত এই গুপ্তহত্যা মিশনের প্রথম শিকার হলেন সালেহ আল-আরোরি।
গুপ্তহত্যার জন্য সালেহকে ইসরাইল সতর্কতার সঙ্গেই বেছে নিয়েছে। কারণ, তিনি হামাসের অন্যতম জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা। এছাড়া ইরান ও লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন হিজবুলস্নাহর সঙ্গে হামাসের যোগসূত্র রক্ষার প্রধান ব্যক্তি ছিলেন তিনি।
ইসরাইল-অধিকৃত পশ্চিম তীরেও প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন সালেহ। তার জন্ম পশ্চিম তীরে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় পশ্চিম তীরে সহিংসতা বেড়েছে।
৭ অক্টোবর ইসরাইলে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছিল হামাস। হামাসের এই হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের বেশি ইসরাইলি নিহত হন, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন বেসামরিক লোকজন। একই সঙ্গে প্রায় ২৪০ জনকে ইসরাইল থেকে ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় নিয়ে জিম্মি করে হামাস। কিছু ইসরাইলি কর্মকর্তার ধারণা, সালেহ ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার পরিকল্পনার কথা আগে থেকেই জানতেন।
গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পশ্চিম তীরের হেবরন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে সালেহ ইসলামি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসলামপন্থি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল। প্রথম ইন্তিফাদার জেরে ১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার পরই হামাসে যোগ দেন সালেহ। তিনি হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসেম ব্রিগেডস গঠনে সহায়তা করেছিলেন। ১৯৯২ সালে সালেহকে জেলে পোরে ইসরায়েল। পরবর্তী ১৮ বছরের প্রায় পুরো সময়ই তিনি ইসরাইলি কারাগারে কাটান।
প্রথমে সিরিয়ায় অবস্থান করে হামাসের কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন সালেহ। পরে কাতার যান। সবশেষ তিনি লেবাননে বসে সংগঠনের কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। সালেহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে, বিশেষ করে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হামাসের একজন বিচক্ষণ নেতার খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
পশ্চিম তীরে হামাসের নেটওয়ার্ক ও প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সালেহ। তিনি ফিলিস্তিনের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ফাতাহর সঙ্গে হামাসের যোগাযোগ, আলাপ-আলোচনা, সমঝোতার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছিলেন। উলেস্নখ, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষে এই দলের (ফাতাহ) প্রাধান্য রয়েছে।
দক্ষতাগুণে হামাসের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাঠামোয় পদোন্নতি পেয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকেন সালেহ। তিনি হামাসের শক্তিশালী 'পলিটবু্যরোর' সদস্য।
২০১৭ সালে সালেহ হামাসের রাজনৈতিক বু্যরোর উপপ্রধান নির্বাচিত হন। হামাসের রাজনৈতিক বু্যরোর প্রধান ইসমাইল হানিয়া।
হামাসের রাজনৈতিক বু্যরোর উপপ্রধান হওয়ার পর সালেহর ভূমিকা আরও বেড়ে যায়। তিনি হামাসের উচ্চ পর্যায়ের একজন গুপ্তদূত হিসেবে কাজ করছিলেন। হামাসের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। তিনি হামাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ মুখপাত্রও ছিলেন। তবে সালেহ তার কট্টরবাদী পরিচিতিও বজায় রেখেছিলেন।
পশ্চিম তীরে হামাসের সামরিক অভিযানে অর্থায়নসহ তা পরিচালনার জন্য ২০১৫ সালে সালেহকে অভিযুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বা অর্থ দপ্তর। বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলা, ছিনতাই ও অপহরণের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক সন্ত্রাসীর তালিকায় সালেহর নাম তোলে। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য তথ্য চেয়ে তারা পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করে।
৭ অক্টোবরের হামলার পরপরই হিজবুলস্নাহ নেতা হাসান নাসরুলস্নাহর সঙ্গে দেখা করেন সালেহ। ইসরাইলের সঙ্গে হামাসের যুদ্ধে 'প্রকৃত বিজয় অর্জনের কৌশল' নিয়ে আলোচনা করেন তারা। পরে বৈঠকটির ছবি প্রচার করা হয়।
পাল্টা হিসেবে ৭ অক্টোবর থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। একপর্যায়ে কাতারের মধ্যস্থতায় কয়েক দিনের যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, হামাস কিছুসংখ্যক জিম্মিকে মুক্তি দেয়। বিনিময়ে বেশ কিছু ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেয় ইসরায়েল। যুদ্ধবিরতির এই আলোচনায় সালেহর ভূমিকা ছিল।
ইসরায়েলের বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, উভয় পক্ষের ব্যক্তিদের মুক্তির তালিকা তৈরিতে সালেহর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তার এই ভূমিকাকে 'অপরিহার্য' হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বারবার ইঙ্গিত দিয়ে এসেছেন যে হামাস নেতারা তাদের নিশানায় আছেন। গত নভেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, তিনি ইসরাইলের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে এই নির্দেশ দিয়েছেন যে হামাসের সব নেতা, তারা যে যেখানেই থাকুন না কেন, তাদের হত্যা করতে হবে।
গত ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেটের প্রধানের একটি রেকর্ডিং ফাঁস হয়। এতে তিনি ইসরাইলি পার্লামেন্টের সদস্যদের বলেন, গাজা, পশ্চিম তীর, লেবানন, তুরস্ক, কাতার সর্বত্র হামাস নেতাদের হত্যা করা হবে।
১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরাইলি দলের ওপর একটি সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামলা চালায়। এই হামলার জেরে গুপ্তহত্যা মিশন শুরু করেছিল ইসরাইল। এর সঙ্গে ইসরাইলের বর্তমান গুপ্তহত্যা মিশনের তুলনা করা হচ্ছে। সেই প্রচেষ্টার মতো এই মিশনও (গুপ্তহত্যা) ইসরাইলিদের আশ্বস্ত করতে পারে।
৭ অক্টোবর হামাসের হামলার বিষয়ে আগে জানতে না পারার মতো অত্যন্ত গুরুতর গোয়েন্দা ব্যর্থতার জেরে ইসরাইলের বর্তমান সরকার তীব্র সমালোচনা ও প্রচন্ড চাপের মধ্যে আছে। নেতানিয়াহুর নেওয়া গুপ্তহত্যার মিশন তার সরকারের প্রতি জনসমর্থন জোরদার করতে পারে।
তবে উদ্বেগও আছে। কেননা, এই ধরনের কৌশল ইসরাইলের জন্য বুমেরাং হতে পারে।
ইসরাইলের আগের গুপ্তহত্যার নিশানা থাকা কেউ কেউ গার্ডিয়ানকে বলেছেন, তারা নিবৃত্ত হননি, বরং তারা আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন।
অন্যরা বলছেন, এই ধরনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে ব্যক্তি বা সংগঠনের যেকোনো ক্ষতিই সাময়িক।
বিশ্লেষকরাও বলেছেন, গুপ্তহত্যার পরিণতি প্রায়ই খুব অপ্রত্যাশিত বা অনিশ্চিত হয়ে থাকে। একজন নেতার মৃতু্য একটি গোষ্ঠীকে তার কৌশল পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে। এমনকি সহিংসতা ত্যাগ করতেও বাধ্য করতে পারে। কিন্তু একইভাবে অন্য কারও উত্থান ঘটাতে পারে, যিনি হয়তো আরও অনমনীয়।
সালেহর হত্যাকান্ড ইসরাইলের যুদ্ধকে দুটি ফ্রন্টে নিয়ে যেতে পারে। সেটি হবে এমন এক দৃশ্য, যা ইসরাইল আগে এড়াতে চেয়েছিল।