টাঙ্গাইলে ভোটযুদ্ধে সিদ্দিকী পরিবারের তিন ভাই
প্রকাশ | ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইলের তিনটি আসনে প্রভাবশালী সিদ্দিকী পরিবারের তিন ভাই ভোটযুদ্ধে নেমেছেন। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে ভোটের মাঠে ভোটার ও সাধারণ মানুষ তিন ভাইয়ের পৃথক তিনটি আসনে কষছেন নানা হিসাব-নিকাশ ও সমীকরণ।
সিদ্দিকী পরিবারের বড় ভাই সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসন থেকে গামছা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি
বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম। তাদের ছোট ভাই মুরাদ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে মাথাল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। তিনটি আসনেই শাসক দল আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের টক্কর হবে।
টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী 'সিদ্দিকী পরিবার' মূলত আওয়ামী ঘরনার পরিবার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে পথ চলেন পরিবারের সবাই। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড়ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বরাবরই আওয়ামী লীগার বড় নেতা। তিনি ২০১৪ সালে হজ ও তাবলিগ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃৃত ও মন্ত্রিত্ব হারান। সংসদ থেকেও পদত্যাগ করেন। তবুও তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগার ও সাচ্চা মুসলমান দাবি করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'দেবী' বলে জনসমক্ষে সম্ভোধন করেন। অপর ভাই মহান মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত কিংবদন্তি বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে নানা বিষয়ে আওয়ামী লীগের বিরোধ দেখা দেওয়ার পর তিনি ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ ছেড়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠন করেন। আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়ে যায়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইদানীং তিনি জনসমক্ষে 'বোন' সম্বোধন করেন। তাদের ছোট ভাই মুরাদ সিদ্দিকী কয়েকবার সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করে উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়ে পরাজিত হন। তিনি নিজেকে আওয়ামীলীগার ও বঙ্গবন্ধুর সৈনিক দাবি করেন।
২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর কাদের সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সপরিবারে গণভবনে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। তারপর থেকেই রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন রয়েছে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে যাচ্ছেন। এতে পাল্টে যায় টাঙ্গাইলের রাজনৈতিক পরিবেশ। লতিফ সিদ্দিকীকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য দেন কাদের সিদ্দিকী। ফলে লতিফ সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগের ফেরানো হতে পারে বলে অনেকের ধারণা ছিল।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম জানান, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। ভোট ডাকাতি হবে না। তার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী কালিহাতীতে নির্বাচন করছেন। তার কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ লতিফ সিদ্দিকীকে সমর্থন দিচ্ছে। সুষ্ঠু ভোট হলে কালিহাতীতে লতিফ সিদ্দিকী অবশ্যই নির্বাচিত হবেন। বাসাইল-সখীপুর আসন নিয়ে তিনি জানান, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন অনুপম শাহজাহান জয়। তিনি তার বাবা প্রয়াত শওকত মোমেন শাহজাহানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ভোটের মাধ্যমে তিনি নির্বাচিত হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী- মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন। প্রাজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান তিনি। তিনি ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মন্ত্রী হন। ২০১৪ সালে মন্ত্রিত্ব হারান। আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কৃত হন। জাতীয় সংসদে ঐতিহাসিক বক্তব্য দিয়ে সংসদ থেকেও পদত্যাগ করেন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে ট্রাক প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। পরে নির্বাচন থেকে সরে যান। এবার নির্বাচনে কয়েক মাস আগে থেকে মাঠে নামেন। কালিহাতীতে তার অসংখ্য কর্মী, ভক্ত-অনুসারী রয়েছেন।
এ আসনে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ৩২ বছরের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু এবং মহান স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের মেয়ে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সারওয়াত সিরাজ শুক্লা। মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী লতিফ সিদ্দিকীর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ছিলেন এবং শুক্লা সিরাজের বাবা শাজাহান সিরাজ তার বন্ধু ছিলেন।
লতিফ সিদ্দিকী বলেন, 'আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন যোদ্ধা ও আওয়ামী লীগার। বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে- তারা শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করতে চায়। আমি মনে করি এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা আমার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই আমি কালিহাতীর মানুষকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছি। কালিহাতীর মানুষ আমাকে যে ভালোবাসা দেখিয়েছে- সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে আমি নির্বাচনে এসেছি।'
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম মহান মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসন থেকে দলীয় প্রতীক গামছা নিয়ে নির্বাচন করছেন। ১৯৯৬ সালে কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৯ সালে দল থেকে বেরিয়ে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রয়াত শওকত মোমেন শাহজাহানের কাছে পরাজিত হন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে এ আসন থেকে কাদের সিদ্দিকী জয়ী হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে কালিহাতী আসন থেকেও কাদের সিদ্দিকী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন তার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী। বিএনপির প্রার্থী ছিলেন শাজাহান সিরাজ। শাজাহান সিরাজ নির্বাচিত হয়ে জোট সরকারের মন্ত্রিত্ব পান। গত তিনটি নির্বাচনে ঋণ খেলাপির কারণে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তমের মনোনয়ন বাতিল হয়। ২০১৮ সালে এ আসন থেকে তার মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী জোটের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যান।
মুরাদ সিদ্দিকী তার বড়ভাই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তমের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের মনোনীত প্রার্থী হয়ে ২০০১ ও ২০০৮ সালে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়ে পরাজিত হন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে সামান্য ভোটে হেরে যান। ২০১৪ সাল থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগদানের চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি সখ্যতা বাড়িয়েছেন। ২০২২ সালে মুরাদ সিদ্দিকী প্রায় ১০ হাজার কর্মী-সমর্থক নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেন। মুরাদ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে পদ পাচ্ছেন এ নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নেতাকর্মীরা উৎসাহ-উদ্দীপনায় ছিলেন। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে মুরাদ সিদ্দিকী স্থান পাননি। তবে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটিতে একটি সদস্যপদ ফাঁকা রয়েছে। অনেকের ধারণা ওই পদে তাকে নেওয়া হতে পারে। দলীয় হাইকমান্ডের ইচ্ছায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম ক্রয় ও জমা দেন মুরাদ সিদ্দিকী। পরে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হন।
টাঙ্গাইল সদর আসনে মুরাদ সিদ্দিকীর রয়েছে একটি নিজস্ব ভোট ব্যাংক। এবার নির্বাচনকে ঘিরে সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও জনসভা করছেন।
মুরাদ সিদ্দিকী বলেন, আমি আওয়ামী পরিবারের সন্তান, মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী পরিবারের সন্তান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে জননেত্রী শেখ হাসিনার একজন কর্মী। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছি। আমি আওয়ামী লীগের বাইরের কেউ নই। দল থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলাম- পাইনি। তবে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে সদর আসনে নির্বাচন করছি।
মুরাদ সিদ্দিকী আরও বলেন, জনগণ আমাকে ভালোবাসে, আমার পাশে আছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে ভোটের মাধ্যমে আমি নির্বাচিত হব ইনশাআলস্নাহ।
টাঙ্গাইল সদর আসনে মুরাদ সিদ্দিকীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী অ্যাডভোকেট মামুন অর রশিদ ও ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান এমপি মো. ছানোয়ার হোসেন।